আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

স্যাটেলাইট ট্যাগ নিয়ে সুন্দরবনের কুমির ঘুরছে বরিশালের নদীতে


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৪ ৭:৪৯ অপরাহ্ণ স্যাটেলাইট ট্যাগ নিয়ে সুন্দরবনের কুমির ঘুরছে বরিশালের নদীতে
Spread the love

বার্তা ডেস্ক ॥  সুন্দরবনের লোনা পানির চারটি কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্যাগ লাগানোর পরে দেখা যাচ্ছে, এর তিনটি সুন্দরবনে ফিরে গেলেও একটি বহু পথ ঘুরে এখন বরিশাল বিভাগের জেলা পিরোজপুরে ঘোরাফেরা করছে।

কুমিরের আচরণ ও গতিবিধি জানতে সম্প্রতি চারটি কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে সুন্দরবনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো। এর মধ্যে তিনটি সুন্দরবনের বিশাল এলাকায় চলে যায়। তবে একটি কুমির বন ছেড়ে মংলা, বাগেরহাট, মোড়েলগন্জ হয়ে এখন পিরোজপুরে ঢুকে পড়েছে।

মাত্র এগারো দিনে প্রায় একশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে কুমিরটি। গায়ে বসানো স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে কুমিরটি বুধবার সকালে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার তুষখালির একটি নদীতে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা আশা, নির্দিষ্ট সময় পর হয়তো আবারো সুন্দরবনে ফিরে আসতে পারে কুমিরটি। তবে আপাতত সে তার নিজের জন্য নিরাপদ পরিবেশ খুঁজছে।

গত ১৬ মার্চ স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে কুমিরটি অবমুক্ত করা হয়েছিলো সুন্দরবনের হারবাড়িয়া পয়েন্টে। এরপর এটি মংলা, রামপাল, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ হয়ে পিরোজপুরে ঢুকেছে।

বন বিভাগ বলছে, এই গবেষণার মাধ্যমে সুন্দরবনের কুমিরের চলাচল ও গতিপথ সম্পর্কে তারা জানতে চায়।

বন সংরক্ষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ইমরান আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা মূলত এই গবেষণার মাধ্যমে তাদের আচরণ ও বসবাসের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করেছি। যে কুমিরটি বনের বাইরে গেছে সে হয়তো তার বসবাসের জন্য সুবিধাজনক জায়গা খুঁজছে”।

কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে নদীতে অবমুক্ত করার কাজটি যৌথভাবে করছে বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। তাদের সহযোগিতা করছে, জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (জিআইজেড)।

আইইউসিএন এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার সারোয়ার আলম দীপু বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সুন্দরবনের কুমির কোথায়, কিভাবে বিচরণ করে তা নিয়ে বিস্তারিত কোন গবেষণা হয় নি। সে কারণেই স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে এই গবেষণাটি করা হচ্ছে”।

বিশ্বে পাখি, কচ্ছপ, নেকড়েসহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণার নজীর রয়েছে। তবে বাংলাদেশের কুমির নিয়ে এভাবে গবেষণা এই প্রথম করা হচ্ছে।

যেভাবে শুরু হলো গবেষণাটি

গত ১৩ থেকে ১৬ই মার্চের মধ্যে মোট চারটি লোনা পানির কুমিরে এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়। এই চারটি কুমিরের মধ্যে দুটি পুরুষ এবং দুইটি স্ত্রী কুমির।

এদের মধ্যে পুরুষ কুমির জুলিয়েট সুন্দরবনের করমজলে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পুকুরে ছিল। আর স্ত্রী কুমির মধুকে সম্প্রতি যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ির মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া বাকি দুটি কুমির ফাঁদ পেতে ধরা হয় সুন্দরবনের খাল থেকে। এই মোট চারটি কুমিরে স্যাটেলাইট ট্যাগ স্থাপন করে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের খালে।

এই কাজের জন্য আইইউসিএন বাংলাদেশ নিয়ে আসে কুমির গবেষক ড. সামারাভিরা ও পল বেরিকে। তারা দু জন অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিলেন।

আইইউসিএন এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার সারোয়ার আলম দীপু বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই গবেষক টিমের পরিকল্পনা ছিল মোট পাঁচটি কুমিরের গায়ে স্যাটেলাইট ট্যাগ বসানো। সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করি আমরা”।

তবে শেষ পর্যন্ত একটি বাদে মোট চারটি কুমিরের গায়ে বসানো হয় স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার।

কুমিরে কিভাবে বসানো হল স্যাটেলাইট ট্যাগ?

গত ১৩ মার্চ সুন্দরবনের করমজলের কুমির প্রজনন কেন্দ্র থেকে বাছাই করা হয় জুলিয়েটকে নামের একটি কুমিরকে। সকালেই সেটির শরীরে ট্যাগ বসানোর কাজ শুরু হয়। ট্যাগ বসানো শেষে ওই কুমিরটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের করমজলের খালে।

যশোরের চিড়িয়াখানা থেকে আনা ‘মধু’ নামের আরেকটি কুমির আনা হয়েছিলো আগে থেকেই। একই দিন সেটিতেও স্যাটেলাইট ট্যাগ বসানো হয়। পরে সেটিকেও ছাড়া হয় একই খালে।

ওই গবেষক দল জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইল্ড লাইফ কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার কিটটি। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি পানির নিচে গেলেও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

কুমিরের গায়ে বসানো এই ট্রান্সমিটার কিটটির মেয়াদ এক বছর। ব্যাটারি চালিত এই যন্ত্রে থাকে একটি ক্ষুদ্র অ্যান্টেনা। যেটি সরাসরি যুক্ত থাকে স্যাটেলাইটের সাথে। ট্যাগ লাগানোর পরই চালু হয়ে যায় এর লোকেশন অপশন। সেটি প্রতি ঘণ্টার আপডেট তথ্য ম্যাপের মাধ্যমে শেয়ার করে।

গবেষক দলের সদস্য মি. দীপু বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই কিটটির মেয়াদ এক বছর হলেও এটি চাইলে আরও বাড়ানো যাবে”।

এর পরের দুই দিন রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের খাল থেকে ফাঁদ পেতে ধরা হয় আরো দু’টি কুমির। সেই দুটির গায়েও একইভাবে বসানো হয় এই স্যাটেলাইট ট্যাগ।

কুমিরের মাথার ওপরের অংশে আঁশের মতো যে স্কেল থাকে। ওই স্যাটেলাইট ট্যাগটি বসানোর জন্য সেখানে ছোট একটা ছিদ্র করতে হয়। ওই ছিদ্রের মধ্যেই বসানো হয় এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারটি।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ইমরান আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই ট্রান্সমিটার চিপটি খুব হালকা। যার ওজন দুই গ্রামেরও কম। যেটি একটি কুমিরের শরীরের ওজনের চেয়েও কয়েকগুণ কম। এই ধরনের চিপ বসানো হলে তাতে কুমিরের কোন ক্ষতি হয় না”।

ট্যাগ বসানো কুমিরগুলো এখন কোথায়?

কুমির প্রজনন কেন্দ্রের জুলিয়েট, যশোরের চিড়িয়াখানা থেকে আনা মধু এবং সুন্দরবনের খাল থেকে ফাঁদ পেতে ধরা আরও দুটি কুমিরের গতিপথ পর্যালোচনা করা হচ্ছে ওই দিন থেকেই।

এই গতিপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এর মধ্যে তিনটি কুমিরই আছে সুন্দরবনের মধ্যে। কিন্তু একটি কুমির অন্য পথে চলতে শুরু করেছে।

১৬ই মার্চ যে কুমিরটিকে সুন্দরবনের জংলা খাল থেকে ধরে গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়, এর পরদিন থেকেই ওই কুমিরটি সুন্দরবন ছেড়ে ছুটছে লোকালয়ের দিকে।

গত দশদিনে কুমিরটির গতিপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এই কুমিরটি সুন্দরবনের হারবাড়িয়া পয়েন্ট থেকে মংলা, রামপাল, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ হয়ে বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলায় পৌঁছেছে।

স্যাটেলাইট তথ্য বলছে, বর্তমানে বাকি তিনটি কুমিরই এখন অবস্থান করছে সুন্দরবনের মধ্যে নদী ও খালে।

এর মধ্যে জুলিয়েট ও মধু ট্যাগধারী কুমির দুটি হারবাড়িয়া পয়েন্টের কাছাকাছি নদীতে রয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। আর অন্য যে কুমিরটিকে করমজল থেকে ধরে ট্যাগ বসিয়ে সেখানকার খালে ছাড়া হয়েছিলো। সেটি এখন আশপাশের খালেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তিনটি কুমির সুন্দরবনের মধ্যে থাকলেও একটি কেন এত পথ পাড়ি দিয়ে লোকালয়ের নদীগুলোতে ঢুকে পড়েছে সেটি নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন আছে গবেষক দলেরও।

গবেষক সারোয়ার আলম দীপু বলছেন, “লোনা পানির কুমিরগুলো আসলে কোন কোন দিকে মুভ করে সেটা আমরা জানতে চেয়েছিলাম। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য আমাদের এক গবেষণার ধারণাকে স্পষ্ট করছে”।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিচের দিকে সমুদ্রের কাছে নদীতেও অনেক স্যালাইন থাকে। আবার কোন কুমির যদি কম লবণাক্ততা পছন্দ করে, সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে আশপাশের নদী খালগুলোতে যায়।

বিশেষজ্ঞ মি. আহমেদ বলেন, “ওই এলাকার পানিতে লবণাক্ততা কম বলে হয়তো সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। কিংবা সে যা খায় সেগুলো হয়তো সে বেশি পাচ্ছে সে কারণে কুমিরটি ওদিকে অগ্রসর হচ্ছে”।

কুমির নিয়ে এ ধরনের গবেষণা কেন?

বর্তমানে বাংলাদেশে কেবল সুন্দরবন এলাকাতেই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোনা পানির কুমির দেখা যায়। তারপরও এই পরিবেশে লোনা পানির কুমিরের এই প্রজাতির প্রজনন খুব একটা হচ্ছে না।

আইইউসিএন’র গবেষক দলটি বলছে, কুমির নিয়ে এর আগে কিছু গবেষণা হলেও বিশদ কোন কাজ হয়নি। এ কারণেই কুমিরের অভ্যাস আচরণ জানার জন্য এই গবেষণাটি করা হচ্ছে।

আইইউসিএন’র গবেষক মি. দীপু বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কুমির কোন অঞ্চলে ডিম পারে, কোন অঞ্চলে স্ত্রী-পুরুষের সংখ্যা কেমন সেটা জানার জন্য এমন গবেষণার পরিকল্পনা অনেক দিন আগে থেকেই ছিলও। এবার প্রথমবারের মতো যেটি শুরু হলো।

বিশেষজ্ঞ ও বন কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা লবনক্ততা বাড়া-কমার কারণেও জীবন জীবিকায় এক ধরণের প্রভাব পড়ছে। হুমকির মুখে পড়ছে এই বন্যপ্রাণীটি। কুমিরগুলোকে বাঁচাতে তাই এই ধরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

জিআইজেড এর ‘ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব সুন্দরবন ম্যানগ্রোভস অ্যান্ড দ্যা মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া সোয়াস অব নো গ্রাউন্ড বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণাটি চলছে।

বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখন যেভাবে লোনা পানির কুমির নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এই গবেষণা ফলপ্রসূ হলে মিঠা পানির কুমির নিয়েও এভাবে গবেষণা করা দরকার বলে মনে করি আমরা”।