আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

অর্থাভাবে বরিশাল-ভোলা সেতু নির্মাণে বিলম্ব


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: এপ্রিল ০৪, ২০২৪ ৭:৩২ অপরাহ্ণ অর্থাভাবে বরিশাল-ভোলা সেতু নির্মাণে বিলম্ব
Spread the love

বার্তা ডেস্ক ॥  দ্বীপ জেলা ভোলাকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে দিতে ১০ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হয়েছে। বরিশাল-ভোলা সেতু নির্মাণে প্রয়োজন ১৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। সমীক্ষায় ২০২৬ সালে নির্মাণকাজ শুরুর কথা বলা হলেও প্রকল্পটির অর্থায়ন নিশ্চিত নয়। ২০২০ সালেও সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা জরিপ হয়েছিল। অর্থাভাবে সেতু নির্মাণে দেরি কিংবা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হলে সমীক্ষার খরচ যাবে জলে। ৩৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা মাস্টারপ্ল্যান করছে সেতু বিভাগ। এ প্রকল্পের আওতায় বরিশাল-ভোলা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হচ্ছে। সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন সমকালকে বলেন, মহাপরিকল্পনার আওতায় সমীক্ষার কাজ এখনও চলছে। তাই অর্থায়নের বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। মহাপরিকল্পনা সম্পন্ন হওয়ার পর দেখা হবে কোন প্রকল্পটি অগ্রাধিকার পাবে।

অতীতে সেতু বিভাগ কয়েকটি বড় অবকাঠামো নির্মাণে সমীক্ষা করলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চললেও আলাদা পাতাল রেল (সাবওয়ে) নির্মাণে ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ে সমীক্ষা করেছিল সেতু বিভাগ। প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা প্রয়োজন সাবওয়ে নির্মাণে। মেট্রোরেলের নির্মাণ চলমান থাকা অবস্থায় বিপুল ব্যয়ে সাবওয়ে নির্মাণের সমীক্ষা করা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রকল্পের টাকা জলে গেছে বলে অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

বরিশাল-ভোলা সেতুর সমীক্ষায় একই পরিণতির শঙ্কা রয়েছে কিনা– প্রশ্নে সচিব বলেন, মহাপরিকল্পনা তো ২০৫০ সাল মাথায় রেখে করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্প প্রমেজিং, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। সমীক্ষার পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে অর্থায়ন খোঁজা হবে।

সাবওয়ের সমীক্ষা করেছিল যে ভারতীয় পরামর্শক, সেই টিপসার নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম নতুন সমীক্ষা করেছে। আগের সমীক্ষা পর্যালোচনা করেছে। গত মাসে সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তেঁতুলিয়া এবং কালাবদর নদীর ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণে তিনটি বিকল্প অ্যালাইনমেন্ট করেছে। বরিশাল-ভোলা পথে সেতু নির্মাণে পরামর্শ দিয়েছে।

২০১৩ সালে শুরু করে বরিশাল-ভোলা সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপ ২০২০ সালের আগস্টে সম্পন্ন হয়। সেতু দিয়ে ভোলার গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, শিগগির শুরু হবে নির্মাণকাজ। তখন মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সেতুর ডিপিপির কাজ চলছে। অর্থায়নে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে।

সমীক্ষায় যা রয়েছে >> সেতু নির্মাণ হলে বছরে ৬ দশমিক ৩৮ কোটি কিলোমিটার দূরত্ব সাশ্রয় হবে। সময় সাশ্রয় হবে ৫১ দশমিক ৯ কোটি ঘণ্টা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে দশমিক ৮৬ শতাংশ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু সম্ভব হলে আট বছরে নির্মিত হবে সেতুটি। ২৪ বছরে নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে টোল আদায়ের মাধ্যমে। ২০৩৩ সালে সেতুতে দৈনিক ৫ হাজার যানবাহন চলবে। ২০২০ সালের সমীক্ষায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা।

ভায়াডাক্টসহ পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, যা দেশের দীর্ঘতম সেতু। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভায়াডাক্টসহ বরিশাল-ভোলা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ১৬ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার। ভোলা ও বরিশাল প্রান্তে সাড়ে ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। সেতু নির্মাণে করতে হবে ১৮ কিলোমিটার নদী শাসন। জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৫০৭ একর। যে এলাকায় সেতু নির্মাণ করা হবে, তা ইলিশের অভয়ারণ্য। তাই রাতে কাজ না করা, শব্দ কমানোসহ কিছু সুপারিশ রয়েছে সমীক্ষায়।

সমীক্ষায় ২০ দশমিক ২৫ মিটার প্রশস্ত সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যালেন্স ক্যান্টিলিভার স্প্যানের দৈর্ঘ্য হবে ২০০ মিটার। এর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ০৬ কিলোমিটার। ভায়াডাক্টে প্রিকাস্ট বিমে স্প্যান হবে ৪০ মিটারের। দুই নদীর মাঝে শ্রীপুর চর দিয়েও যাবে ভায়াডাক্ট।

সমীক্ষা অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণে ৪ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, ভায়াডাক্ট এবং সংযোগ সড়ক নির্মাণে ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা খরচ হবে। নদী শাসনে লাগবে ৪ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। নকশা প্রণয়ন, জমি অধিগ্রহণ, মূল্য বৃদ্ধিজনিত ব্যয়সহ সেতু নির্মাণে লাগবে ১৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা।

সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি), নকশার জন্য দরপত্র, ভূমি অধিগ্রহণ (এলএপি) এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনায় (আরএপি) দুই বছর লাগবে। নকশা প্রণয়নে লাগবে এক বছর। ছয় মাস প্রয়োজন ঠিকাদার নিয়োগে। সেতু নির্মাণে ৭৮ মাস লাগবে। ২০৩২ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। যদিও অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমীক্ষা যে সময় বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি লাগে প্রকল্প বাস্তবায়নে।

পদ্মা সেতুতে পাইলের ব্যাস ৩ মিটার। পাইলের গভীরতা ১২৮ মিটার। প্রস্তাবিত বরিশাল-ভোলা সেতুতে পাইলের ব্যাস হবে আড়াই থেকে ৩ মিটার। গভীরতা হবে ৮৫ থেকে ৯০ মিটার। সেতু কোথায় নির্মাণ করা হবে, তা নির্ধারণে তিনটি বিকল্প পথের সমীক্ষা করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এর দুটি বরিশাল থেকে ভোলা। অন্যটি পটুয়াখালী থেকে ভোলা।

জাতীয় মহাসড়ক এবং বরিশাল নগরের সঙ্গে দূরত্ব এবং বিদ্যমান যাতায়াত ব্যবস্থা বিবেচনা তেঁতুলিয়া এবং কালাবদর নদীর ওপর বরিশাল সদর থেকে ভোলার পথে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২০ সালের সমীক্ষা জরিপে এক্সট্রাডোজ সেতু নির্মাণের প্রস্তাব থাকলেও এবারের সমীক্ষায় ব্যালেন্স ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ব্যালেন্স ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণে কিলোমিটারে ১০ শতাংশ কম খরচ হবে।

সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২ সালে বরিশাল-ভোলা পথে দৈনিক গড়ে ৯২৩টি যানবাহন চলাচল করত। বর্তমান গতিতে প্রবৃদ্ধি হলে সেতু নির্মাণ না হলে বরিশাল-ভোলা পথে ২০৬২ সালে দিনে গড়ে ৬ হাজার ৮৫৮টি যানবাহন চলাচল করবে। আর সেতু নির্মিত হলে এই পথে ২০৬২ সালে দৈনিক গড়ে ৪৩ হাজার ৬৯০টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০৩২ সালে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে ২০৩৫ সালে গড়ে ১১ হাজার ৯২৪টি যানবাহন চলবে। সেতু নির্মাণ না হলে, এই বছরে যানবাহন চলবে গড়ে ২ হাজার ৫৭০টি।

যদিও ২০২০ সালে সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, সেতু নির্মিত হলে ২০৫৪ সালেই দৈনিক গড়ে ৫৬ হাজার ৭০১টি যানবাহন চলবে। এই পূর্বাভাসকে ভুল বলা হয়েছে চলমান সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, ২০৫৪ সালে দৈনিক গড়ে ৩৫ হাজার ৩৫৫টি মোটরযান চলবে।

সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, আর্থসামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বরিশাল-ভোলা সেতু লাভজনক প্রকল্প হবে। ২০৫৬ সালের মধ্যে সেতুর নির্মাণ খরচ উঠে আসবে। অর্থ বিভাগের ২০১২ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) প্রকল্পে মোট ব্যয়ে ৪০ শতাংশের বেশি টাকা ভায়াবেলিটি গ্যাপ ফান্ড (ভিজিএফ) হিসেবে বিনিয়োগ করতে পারবে না। তাই বরিশাল-ভোলা সেতু পিপিপিতে করা যাবে না।

আগের সমীক্ষা জরিপের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং আর্থিক রিটার্নে বড় অমিল রয়েছে চলমান সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন হবে ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগের জরিপে তা দেখানো হয়েছিল ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সমীক্ষায় বেনিফিট কস্ট দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ৩৪। আগের জরিপে তা ছিল ২ দশমিক ৪৬। অর্থাৎ আগের জরিপে অতিরঞ্জিত তথ্য ছিল।’