আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

বরিশাল বিসিকে বিদ্যুৎ সংকটে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২৪ ৬:০২ অপরাহ্ণ বরিশাল বিসিকে বিদ্যুৎ সংকটে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত
Spread the love

নিজেস্ব প্রতিবেদক ॥ বিসমিল্লাহ পলিমার ও প্যাকেজিং মিলসের পলি তৈরির মেশিনটি চালু হওয়ার পর এটি উত্তপ্ত হয়ে উৎপাদন শুরু করতে সবমিলিয়ে চারঘন্টা সময় লাগে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি নতুন করে শুরু করতে হয়। এতে ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন। ক্ষুদে উদ্যোক্তা ও বিসমিল্লাহ পলিমারের পরিচালক নাজমুন নাহার রিনা জানান, প্রতিমাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার পরেও আমরা পর্যাপ্ত সেবা বঞ্চিত। এজন্য বিসিকের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা খুবই জরুরী। সাবস্টেশন নয়; পূর্ণাঙ্গ একটি বিদ্যুৎ স্টেশন বিসিকে প্রয়োজন দাবি করে নাজমুন নাহার রিনা বলেন, এখানে ছোটবড় ৭৫টি প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছে। বখাটেদের উৎপাত লেগেই আছে। তাই এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি, একটি চিকিৎসাকেন্দ্র এবং ফায়ার সার্ভিসের শাখা থাকা খুবই জরুরী। নাজমুন নাহার রিনার সাথে সহমত পোষণ করে বরিশাল বিসিকের ক্ষুদ্র শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জেআইবি ফুড প্রোডাক্টসের পরিচালক ইব্রাহিম খান বলেন, একেতো আমাদের বিসিকের যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম আজো খুলনা নির্ভর হয়ে আছে। তার উপর বিসিক শিল্প এলাকার জন্য একটি নিজস্ব বিদ্যুৎ স্টেশন দেয়ার কথা কিন্তু একটি সাবস্টেশন করে সেখান থেকে আবার বাহিরেও সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ফলে বিসিক শিল্প এলাকার চাহিদা পূরণ হচ্ছেনা। এছাড়াও অগ্নিদুর্ঘটনা ও বখাটেদের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য একটি হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসের শাখা ও পুলিশ ফাঁড়ি খুবই জরুরী প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিসিকের উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বরিশালের নির্ধারিত এলাকায় ইতোমধ্যে বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি জুতো, পোশাক, শিশু খেলনা, হস্তশিল্প, ফুডস, প্যাকেজিং ইত্যাদি বাজারজাত করে সুনাম অর্জন করেছে। এদের কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বলেও দাবী উদ্যোক্তাদের। সূত্রমতে, বরিশালে বিসিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। প্রায় ১৩১ একর জমির শিল্পনগরে ওইসময় প্লটের সংখ্যা ছিলো ৪৪৬টি। এরমধ্যে ৩৭৮টি প্লট বরাদ্দ দিতে পেরেছিলো বিসিক প্রশাসন। বরাদ্দ করা প্লটে শিল্প ইউনিট সংখ্যা ছিলো ১৭৩টি। যারমধ্যে ৭২টি উৎপাদনে ছিলো। পরবর্তীতে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ২৩০ একর জমিতে দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা দীর্ঘদিন আটকে ছিলো বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক জটিলতায়। বর্তমানে সিটি বান্ধব মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত দায়িত্ব গ্রহণের পর এ সংকট কেটেছে বলে জানিয়েছেনন উদ্যোক্তারা। মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দরা জানিয়েছেন, বরিশাল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীমও এখন বিসিক শিল্প এলাকা নিয়ে আন্তরিক। বর্তমানে এখানে এখন ছোট-বড় ১৩৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এবং ৭৫টি উৎপাদনশীল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নিচু জমি ভরাট ইত্যাদি অব্যবস্থাপনায়। নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়েই ট্রেড লাইসেন্স জনিত সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তবে একইসাথে জ¦ালানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ভোলা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস পেলে পণ্যের উৎপাদনে দ্বিগুণ খরচ কমে যাবে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। অতিসম্প্রতি সরেজমিনে বরিশাল সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কাউনিয়া এলাকার উত্তরপ্রান্তের বিসিক শিল্পনগরীতে প্রবেশ করেই দেখা গেছে, ট্রাক বোঝাই ময়লা আবর্জনা মাখা পলিথিন ঢুকছে একটি প্রতিষ্ঠানে। পিছু নিয়ে এগুলো কি ও কেন এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিস্মিত হতে হয়। বরিশাল বিসিকের একটি প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ পলিমার ময়লা আবর্জনা মাখা ফেলে দেওয়া পলিথিন রিসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে মনোপলি তৈরি করছে। যা বাড়ি নির্মাণ ও ক্ষেত খামারে ব্যবহার করা যায়। ওই পলিমারে প্রায় ৬০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কাজ করছেন। রয়েছে প্রতিবন্ধী ও সামাজিকভাবে অবহেলিত নারীরাও। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজকেও পাওয়া গেল বিসিক শিল্পনগরীতে। তিনি বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রের ছয়জন মেয়ে কাজ করছে। তাই মাঝে মধ্যে তিনি এখানে এসে ওইসব মেয়েদের অবস্থা ও তদারকি করেন। বিসমিল্লাহ পলিমার থেকে একটু সামনেই জেআইবি ফুড প্রোডাক্টসের কারখানা। তার একটু পশ্চিমে এগুতেই চোখে পড়ে ফরচুন গ্রুপের কারাখানা ও শ্রমিকদের কোলাহল। পুকুর পাড়ে রয়েছে বেঙ্গল গ্রুপের কারখানা। বরিশালে যে রপ্তানিমুখী ও আন্তর্জাতিকমানের শিল্প কারখানা চালানো যায়, তার প্রমাণ বহন করছে ফরচুন সুজ। ২০১২ সালে বরিশালের বিসিক শিল্পনগরে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। এখানে তৈরি জুতা রপ্তানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ফরচুন সুজের কারখানা ঘুরে এবং কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই কারখানার কাঁচামাল সবই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই জুতা ইউরোপে যায়। তারা মূলত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্পোর্টসওয়্যার তৈরি করেন। ফরচুনের কর্মকর্তারা বলেন, পায়রা বন্দর চালু হলে তাদের কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিতে সময় কম লাগবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করা জেআইবি ফুড প্রোডাক্টস ইতোমধ্যে সারাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বাজারজাত করে সুনাম অর্জন করেছে। রংপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জসহ ঢাকার বাজারে জেআইবি ফুডসের খাদ্য পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইব্রাহিম খান জানান, বরিশাল বিসিকে বর্তমানে ৭৫টি প্রতিষ্ঠান চলমান রয়েছে। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতির এই নেতা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বরিশাল জেলা কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, জেলায় বড় ও মাঝারি শিল্প রয়েছে ১৫টি। ক্ষুদ্র শিল্প আছে ১ হাজার ৯৫৫টি। কুটির শিল্প আছে ৯ হাজার ৭১৯টি। বরিশাল বিসিক শিল্প এলাকার প্রকল্প পরিচালক জালিস মাহমুদ জানান, বিসিকের উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ওই টাকার বেশিরভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছে। চারপাশের দেয়াল ও নিচু জমি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু ড্রেন ও কালভার্টের কাজ বাকি। এই কাজ শেষ হলে এখানে কমপক্ষে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বরিশালের উন্নয়ন নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, শিল্পের দিক দিয়ে বরিশাল অন্য বিভাগগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। যার প্রধান কারণ বরিশালে গ্যাস নেই। পাশাপাশি বিদ্যুতের ঘাটতিও প্রবল। উদ্যোক্তা, সস্তা শ্রম ও জমি থাকার পরেও এই জেলায় শিল্পের বিনিয়োগ হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী বলেন, বরিশাল বিভাগে শিল্প গড়ার দিকে সরকারও কখনো নজর দেয়নি। যদি দিতেন তাহলে এতোদিনে বরিশাল শহরে গ্যাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত হতো। দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) হয়েছে। নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে কিন্তু বরিশালে কিছুই হচ্ছেনা। এমনকি বরিশালে যে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগর আছে, সেটিও অবহেলিত। যদিও বর্তমান সরকার ও বরিশালের প্রশাসন সম্প্রতি এদিকে মনোযোগ দিয়েছেন। বিসিককে শক্তিশালী করতে সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন যৌথ উদ্যোগ শুরু করেছে। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত না হলে সব উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারিতে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগে ৪৫ হাজার ৭৩৫টি উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে। যা সিলেট ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে সিলেট বিভাগে গ্যাস থাকায় সেখানে অনেক বড় বড় শিল্প হয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বরিশালেও সে সুযোগ পর্যাপ্ত রয়েছে, তবে গ্যাস এখানে খুবই জরুরী। বরিশালের সুশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দরা মনে করছেন, পায়রা বন্দর চালু হলে ভবিষ্যতে দক্ষিণাঞ্চলে যত অর্থনৈতিক কর্মকা- হবে তার কেন্দ্রবিন্দু হবে বরিশাল। এজন্য গ্যাসের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তারা বলেন, বরিশালে ১০০ জনের বেশি ব্যবসায়ী আছেন যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এখানে গ্যাস আসলে তারাই তখন বরিশালে বিনিয়োগ করবেন। এতে করে রাজধানী কেন্দ্রীক চাঁপও অনেক কমে যাবে। বরিশাল বিসিক শিল্পনগরী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক প্লট এখনো খালি পরে রয়েছে। অনেকগুলোতে পুরোনো শিল্পকারখানা বন্ধ অবস্থায় পরে আছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ ও উদ্যোক্তাদের দাবির কথা শুনে বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বিসিকের সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্পনগরী এলাকা এখন এই বরিশাল বিসিক। এটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। তিনি আরও বলেন, বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাদের অনুমোদন বাতিল করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হবে। আগামীতে বরিশাল হবে একটি বাণিজ্যিক নগরী। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিজ জেলায়, নিজ বিভাগে আরো বেশি বিনিয়োগের জন্য জেলা প্রশাসক আহবান করেন।