আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

এক পায়ে লাফিয়ে স্কুলে যায় সুমাইয়া


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২২ ৩:২০ অপরাহ্ণ এক পায়ে লাফিয়ে স্কুলে যায় সুমাইয়া
Spread the love

২০১৬ সালে সুমাইয়ার বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখন তার গুটিবসন্ত (স্মল পক্স) হয়। কিছুদিন পর তার জ্বর হয়। এরপর থেকে তার পা আস্তে আস্তে বেঁকে যেতে থাকে। সুমাইয়া বড় হয়, কিন্তু পা আর সোজা হয় না। সেও এক পায়ে হাঁটার অভ্যাস শুরু করে। একদিন এক প্রতিবেশীর পরামর্শে স্থানীয় কবিরাজের কাছে তাকে নিয়ে যায় তার পরিবার। কবিরাজ ওষুধ দিয়ে বলেন, এ ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যাবে।

সুমাইয়ার পা আর ঠিক হয় না। বাঁকা পা নিয়েই বড় হতে থাকে সে। এদিকে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’ তকমা নিয়ে সেও থেমে যেতে রাজি নয়। তার বয়স যখন ৫ বছর, তখন তার মা-বাবা তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সে-ও পড়াশোনা শুরু করে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে নয়, তাকে প্রায় দুই কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যেতে-আসতে হয় লাফিয়ে লাফিয়ে।

সুমাইয়া আক্তার (১০) চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকডিহি ইউনিয়নের আলীপাড়ার রিকশাচালক শফিকুল ইসলামের মেয়ে। সে উত্তর আলোকডিহি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া সুমাইয়া পিঠে ব্যাগ নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা এক পায়ে লাফিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ব্যাগ রেখে আবার এক পায়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তারপর সহপাঠীদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছে। খেলার সময়ও তাকে লাফাতে হয়। শুধু মাটিতে বসলেই তার বাঁ পা মাটিতে স্পর্শ করতে পারে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বা হাঁটার সময় কোনোভাবেই মাটিতে পা পড়ে না। কোনো দিকে যেতে বা অগ্রসর হতে হলে তাকে ডান পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে যেতে হয়। এভাবেই সব কাজ করতে হয় সুমাইয়াকে।

সুমাইয়ার মা-বাবার সংসারে চরম অভাব। তার রিকশাচালক বাবা মাস দেড়েক আগে মেয়েকে দিনাজপুর মেডিকেলে নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, সুমাইয়ার পায়ে অস্ত্রোপচার করলে পা ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য তিন লাখ টাকার মতো প্রয়োজন হবে। এ শুনে তার বাবা বাড়ি চলে আসেন।

সুমাইয়ার বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় রিকশা চালাই। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। সুমাইয়া আমার মেজ মেয়ে। আমি বাড়িতে থাকলে আমার মেয়েকে কোলে করে স্কুলে আনা-নেওয়া করতাম। এমনিতেই অভাবের সংসার। তাই আয়রোজগারের জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। মেয়ের এভাবে স্কুলে যাওয়া-আসার কষ্ট দেখে বাবা হিসেবে সইতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, এই আট বছরে অনেক চিকিৎসা করেছি কিন্তু কোনো ফল পাইনি। দেড় মাস আগে দিনাজপুর মেডিকেলে নিলে চিকিৎসকরা বলেছেন, তিন লাখ টাকা হলে তাকে ভালো করা সম্ভব। কিন্তু আমার পক্ষে রিকশা চালিয়ে এত টাকা খরচ করা সম্ভব না। তাই আমি আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

সুমাইয়ার মা সুমি আক্তার বলেন, আমার মেয়ে ছোটবেলায় খুব সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল। দুই বছর বয়সে তার গুটিবসন্ত হয়েছিল। এরপর জ্বরটর হলে একদিন দেখি বাঁ পা বাঁকা হয়ে আছে। এরপর থেকে তার পা ছোট হয় যায়। আর মাটিতে পড়ে না।

তিনি আরও বলেন, মেয়ে যখন স্কুলে যায়, তখন লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। এই দৃশ্য আমি মা হয়ে আর সহ্য করতে পারি না। তার কষ্ট দেখলে দুচোখের পানি আটকাতে পারি না। শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আমার মেয়ে যেন সুস্থ হয়ে যায়। সবার মতো স্বাভাবিক দুই পা দিয়ে হেঁটে চলাফেরা করতে পারে।

সুমাইয়ার সমস্যা নিয়ে কথা হয় চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সৌভিক রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, বসন্তরোগ হলে পা বেঁকে যাওয়ার কোনো নজির নেই। তবে শিশুটিকে না দেখে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলা যাবে বসন্তরোগে পা বেঁকে গেছে নাকি অন্য কোনো কারণে বেঁকে গেছে।

প্রতিবেশী জেসমিন আরা বলেন, সুমাইয়া ছোটবেলায় সুস্থই ছিল। দুই বছর বয়সে হঠাৎ তার বসন্তরোগ হয়। পড়ে তার বাম পা বাঁকা হয়ে যায়। গরিব মানুষ হয়েও অনেক চিবিৎসা করেছে কিন্তু কোনো উপকার হয় নাই। এখন ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। এতে অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু সুমাইয়ার বাবা গরিব মানুষ। জমি-জায়গা কিছু নাই যে বিক্রি করে মেয়ের চিকিৎসা খরচ চালাবে। তার বাবা রিকশা চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালান।

উত্তর আলোকডিহি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুনুর রশিদ বলেন, সুমাইয়ার ইচ্ছাশক্তি আমাদের অভিভূত করেছে। চিকিৎসার অভাবে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। তার পড়াশোনা খুবেই ভালো। আমরা তাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। সুমাইয়া আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা। দেশের প্রতিটি শিশু সুশিক্ষা চায়। সেই সুশিক্ষা অর্জন করে সে অনেক বড় হোক, আমরা তার জন্য এই কামনা করি।

চিরিরবন্দর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম‌্যান লায়লা বানু বলেন, আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুমাইয়ার এ অবস্থা দেখে আজ তার বাসায় এসেছি। স্কুলে গিয়ে তার পড়ালেখার খোঁজখবর নিয়েছি। সে মেধাবী ছাত্রী। আমি সুমাইয়ার বিষয়ে এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, অস্ত্রোপচার করতে হবে। আমি সুমাইয়ার প্রাথমিক চিকিৎসার খরচ বহন করার দায়িত্ব নিলাম। তবে একটি কোমলমতি প্রাণের জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।

চিরিরবন্দর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, স্কুলছাত্রী সুমাইয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়টি আমি জেনেছি। আগামী মঙ্গলবার আমার অফিসে তাদের ডেকেছি। এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

সুমাইয়া ‘প্রতিবন্ধী’ ভাতার কার্ড হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো কারণে হয়তো সুমাইয়ার নাম আসেনি, তাই হয়নি। তবে দ্রুত ভাতার কার্ড করে দেওয়া হবে।