বার্তা ডেস্ক ॥ সিরাজুল ইসলাম (৪৫) ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। এ বছর নিজে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখেছেন। এমনও হয়েছে– তাঁর অটোরিকশায় হাসপাতালে যেতে যেতেই ঝরে গেছে শিশুসন্তানের প্রাণ। মা-বাবার বুকফাটা আর্তনাদের ধাক্কাটা পিতা সিরাজকে মুহূর্তে নিয়ে গেছে পটুয়াখালীর দশমিনার বহরমপুর ইউনিয়নের নেহালগঞ্জে।
গামছায় চোখ মুছতে মুছতেই স্ত্রীকে সাবধান করেছেন। মফস্বলেও যেন ডেঙ্গু থেকে আগলে রাখা হয় দুই ছেলে ও আদরের মেয়েকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা হলো– মঙ্গলবার মাত্র ৯ ঘণ্টার ব্যবধানে এই ডেঙ্গুই কেড়ে নিয়েছে সিরাজের স্ত্রী সালমা বেগম (৪০) ও মেয়ে সাদিয়া আক্তারকে (১২)।
স্ত্রী-সন্তানকে দাফনের দু’দিন পরও গতকাল বৃহস্পতিবার নেহালগঞ্জে গিয়ে দরিদ্র পিতা সিরাজের বিলাপে পাঁজর ভাঙার কষ্ট– ‘ফোন দিলেই আমার ছোট মা জামা-জুতা আনতে বলত। এখন আর কেউ আবদার করবে না। কীভাবে বাঁচব আমি? অনেক সাবধান করেও তো শেষ রক্ষা হলো না।’
স্বজনরা জানান, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সিরাজের সংসারে অভাব থাকলেও সুখের কমতি ছিল না। নিজেদের অক্ষরজ্ঞান না থাকার কষ্ট সবসময় পোড়াত। এ জন্য উপার্জনের বড় অংশ খরচ করতেন সন্তানদের পড়াশোনায়। ভাঙাচোরা টিনের ঘরে থেকেও স্বপ্ন বুনতেন ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার। কিন্তু ডেঙ্গু সব তছনছ করে দিয়েছে।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে মারা যান সালমা বেগম। এর ৯ ঘণ্টা পরে বুধবার ভোর ৫টার দিকে মৃত্যু হয় সাদিয়া আক্তারের। দুপুরে একত্রে জানাজা শেষে মা-মেয়েকে পাশাপাশি করবে দাফন করা হয়।
সিরাজ-সালমা দম্পতির বড় ছেলে শামীম হোসেন (১৭) দশমিনা সরকারি আব্দুর রসিদ তালুকদার ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে তামিম হোসেন (৮) নেহালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া। আর মারা যাওয়া মেয়ে সাদিয়া ছিল নেহালগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী।
সরেজমিন দেখা যায়, মা মা বলে অঝোরে কাঁদছে ছোট্ট তামিম। বারবার মায়ের কবরের কাছে ছুটে যাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে ঝরে কাঁদছেন শামীম। স্ত্রী ও আদরের মেয়েকে হারিয়ে নির্বাক সিরাজুল ইসলাম। খড়ের রান্নাঘরে যে প্রায় সপ্তাহ ধরে চুলা জ্বলেনি, তা স্পষ্ট। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে থালা-বাসন। প্রতিবেশীরা খাবার দিলেও শোকে বিহ্বল তা যেন কেউ মুখে তুলছেন না।
শামীম হোসেনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তার মা ও বোন জ্বরে আক্রান্ত হলে স্থানীয় চিকিৎসকের ওষুধ খান। কিন্তু সুস্থ না হওয়ায় গত শুক্রবার দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রোববার বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই ৯ ঘণ্টার ব্যবধানে মারা যান সালমা ও সাদিয়া।
সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হয় বলেই সিরাজুল ইসলাম দীর্ঘদিন পরপর বাড়ি যেতেন। কিন্তু নিয়মিত ফোনে কথা বলতেন। গত শনিবার তিনি প্রায় ৬ মাস পর বাড়িতে যান স্ত্রী ও মেয়ের অসুস্থতায়। হাসপাতালে তাদের পাশে বসে সব ধরনের সাহস জোগালেও তা কাজে আসেনি বলে আক্ষেপ সিরাজের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঢাকায় ভাড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাই। বাড়িতে সালমাই ছিল আমার ঘরের লক্ষ্মী। এক হাতে তিন সন্তানের দেখভাল করত। নিজের আয়েশ ভুলে খাটত।
ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাণহানি ও মানুষের কষ্ট দেখে তাকে বারবার সাবধান করতাম। গ্রামে থাকলেও যেন সতর্ক থাকে; মশারি টানিয়ে ঘুমায়। সে আমাকে অভয় দিত। আমার সংসারে অভাব ছিল সত্যি; সুখের ঘাটতি কখন ছিল না। আমার সোনার সংসার শেষ করে দিল ডেঙ্গু। অভয় দেওয়ার কেউ থাকল না!
সাদিয়ার মৃত্যুর খবরে বাড়িতে ছুটে এসেছেন সহপাঠী ও শিক্ষকরা। নেহালগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশীল কুমার দাস বলেন, সাদিয়া খুব মেধাবী ছিল। এত ছোট বয়সেও সে লেখাপড়ার বিষয়ে ছিল ভীষণ মনোযোগী। জ্বর নিয়েও ক্লাসে এসেছে। বাবার আর্থিক অবস্থা জেনে আমরা তার থেকে কোনো বেতন নিতাম না। এ পরিবারটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য জলিল মল্লিক জানান, দীর্ঘদিন মা-মেয়ে জ্বরে ভুগলেও ভালো চিকিৎসক দেখাতে পারেনি। স্থানীয়ভাবে ওষুধ খেয়েছেন। অসচেতনতার কারণেই অসময়ে ঝরে গেল তাদের প্রাণ।
দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সালমা বেগম ও তাঁর মেয়েকে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আপ্রাণ চেষ্টার পরও শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না দেখে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাফিসা নাজ নীরা জানান, সিরাজুল ইসলামের আর্থিক অসংগতির তথ্য তারা পেয়েছেন। পরিবারটি লিখিত আবেদন করলে সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।