আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

বরিশালের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা শনাক্তে অনাগ্রহ


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৩ ৬:৩৯ অপরাহ্ণ বরিশালের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা শনাক্তে অনাগ্রহ
Spread the love

বার্তা ডেস্ক ॥ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরিশাল জেলার প্রবেশদ্বার গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর, ইল্লা, গাইনেরপাড়, বার্থী, কটকস্থল, টরকী, গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড, আশোকাঠী, কাসেমাবাদ, মাহিলাড়া, বামরাইল, সানুহার, নতুন শিকারপুর, ইচলাদী, নতুনহাট, রহমতপুর ব্রিজ, রেইনট্রিতলা, কাশিপুর ব্র্যাক অফিস মোড়সহ অনেকস্থানই দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

কিন্তু এসব স্পটের তালিকা নেই সরকারি কোনো দপ্তরের কাছে। এমনকি জনসচেতনায়ও কোনো সাইনবোর্ড নেই। ফলে সড়ক পারাপার, পরিবহনে যাতায়াতে দুর্ঘটনার মুখে পরেন মহাসড়ক ব্যবহারকারীরা। পদ্মাসেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আশীর্বাদ হয়ে এলেও ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের পরের সড়ক প্রশস্ত না করায় অপ্রশস্ত সড়কে পরিবহন চালকদের বিবেকহীন প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াগতিতে ওভারটেকিং করতে গিয়ে উল্লিখিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো এখন মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের ২৪ ফুট প্রশস্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে দেশের সর্বদক্ষিণের সাগরকন্যা কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কের প্রশস্ততা না বাড়ানোর কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও অতিসম্প্রতি বাসষ্ট্যান্ডসহ মহাসড়কের বিভিন্ন বাঁকা মোড় সোজা করতে কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। পাশাপাশি ভাঙা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত জাতীয় এ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার জন্য জমি অধিগ্রহণ শেষে মহাসড়কের পাশের শতবছরের গাছগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে কর্তন করা শুরু হয়েছে।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, প্রথমতো এক্সপ্রেসওয়ের পরের সড়ক প্রশস্ত না করায় দুর্ঘটনা নিয়মিতই লেগে রয়েছে। আমাদের সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অদ্ভুত চর্চা থাকায় অনেক কিছুই সুন্দরভাবে সমাধান হচ্ছেনা। এরা অন্যের ওপর দায় চাঁপিয়ে দায়মুক্ত হচ্ছেন। অথচ বহির্বিশ্বে সড়ক-মহাসড়কে নির্দেশনা থাকে। দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা শনাক্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিশেষ নজরদারি করে। সেখানে বাংলাদেশের চিত্রটা পুরোপুরি ভিন্ন।
নিরাপদ সড়ক চাই বরিশাল জেলার আহ্বায়ক রুহুল আমিন বলেন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ করলো সরকার। কিন্তু তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এই আইন বাস্তবায়ন হলে সকল প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতার আওতায় আসবে। তখন গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় সামনে চলে আসবে। তাতে করে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

গৌরনদী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ গোলাম রসুল বলেন, হাইওয়ে পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকা গৌরনদী উপজেলার ভুরঘাটা থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া নতুনহাট পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটারের তথ্য বলতে গেলে সাধারণত বেপরোয়া গাড়ি এবং পথচারীদের অসচেতনতায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পুরো মহাসড়কের যেকোনোস্থানে বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। একইস্থানে অনেকবার দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে কোন কোন এলাকা দুর্ঘটনাপ্রবণ তা আমরা শনাক্ত করিনা।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) বরিশালের সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) মোঃ রুকনুজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিয়মিত সড়কে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া চালক, হেলপাড় এবং পথচারীদের সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পরিবহনগুলোর বেপরোয়াগতিতে বিবেকহীন প্রতিযোগিতা এবং ওভারটেকিং বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সকলকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতা না বাড়লে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো যাবেনা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, গাড়ির ফিটনেস, লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএ কাজ করে। এসবের আইন অমান্য করে সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে বিআরটিএ। তবে কোন কোন স্থান ঝুঁকিপূর্ণ তা আসলে আমাদের শনাক্ত করার সুযোগ নেই। সাধারণত যে প্রতিষ্ঠানের আওতায় যতটুকু সড়ক-মহাসড়ক থাকে যেমন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ তারাই ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক শনাক্ত করে থাকে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের পটুয়াখালী জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আতিক উল্যাহ বলেন, আমরা সড়কের মান উন্নয়নে অর্থাৎ ভেঙে যাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সড়ক সংস্কার করে থাকি। তবে সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ কোনো স্থান বা এলাকা শনাক্তকরণের কোনো তথ্য জানা নেই। এমন কোনো তালিকাও আমাদের কাছে নেই।

৯৮ শতাংশ সড়ক তত্ত্বাবধানের বাহিরে ॥ বরিশাল জোনের আওতায় রয়েছে ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার সড়ক। যারমধ্যে রয়েছে তিনটি জাতীয় মহাসড়ক, সাতটি আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ৬১টি জেলা মহাসড়ক। এই বিশাল দৈর্ঘ্যরে সড়কের মধ্যে মাত্র ৩২ কিলোমিটারের একটু বেশি মহাসড়ক দেখভাল করছে হাইওয়ে পুলিশ। সেই ৩২ কিলোমিটারে দায়িত্ব পালনের জন্যও নেই প্রয়োজনীয় গাড়ি, সরঞ্জাম ও রেকার। এমনকি দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছার জন্য পুলিশের নিজেদের যাতায়াতের গাড়িটিরও বেহাল দশা। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৯৮ শতাংশ সড়ক নেই হাইওয়ে পুলিশের তত্ত্বাবধানে। আর এসব সংকটের কথা স্বীকার করছে হাইওয়ে পুলিশের হেডকোয়াটার্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সূত্রমতে, বরিশাল বিভাগের বরিশাল ও পটুয়াখালী দুটি সড়ক সার্কেলে বিভক্ত। এরমধ্যে বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও ভোলা জেলার সড়ক মিলিয়ে বরিশাল সড়ক সার্কেল এবং পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সড়ক মিলিয়ে পটুয়াখালী সড়ক সার্কেল গঠিত। দুই সার্কেলের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ৯৪ কিলোমিটারের মধ্যে বরগুনা ও পিরোজপুর ব্যতীত চার জেলায় মোট জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে ১২৭ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার। এ ছাড়া ছয় জেলায় আঞ্চলিক মহাসড়ক রয়েছে ২৯০ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং জেলা মহাসড়ক রয়েছে ১ হাজার ১৮৫ দশমিক ৯১ কিলোমিটার। এরমধ্যে হাইওয়ে পুলিশ মাদারীপুর জোনের আওতায় রয়েছে বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার ভুরঘাটা থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া নতুনহাট পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটারের বেশি কিছু অংশ সড়ক। সূত্রে আরও জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধণের পর বরিশাল বিভাগে গাড়ির চাঁপ পূর্বের তুলনায় চারগুন বৃদ্ধি পাওয়ায় একমাত্র গৌরনদী হাইওয়ে থানা পুলিশ তা সামলাতে পারছে না। তাদের আওতায় থাকা ৩২ কিলোমিটারের দায়িত্ব পালন করতেই তাদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই বরিশাল জেলার আহ্বায়ক রুহুল আমিন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খল অবস্থা। হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি না থাকায় তা বহুগুণে বেড়েছে। দুর্ঘটনা কিংবা বেপরোয়াগতি সামলাতে হলে হাইওয়ে পুলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বরিশাল জেলা ও বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাইওয়ে পুলিশ স্টেশন নেই। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করছি হাইওয়ে পুলিশ ও স্টেশন বাড়িয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো উচিত। বরিশালের সাধারণ নাগরিক সমাজের (বসানাস) আহ্বায়ক কাজী ফিরোজ বলেন, ২০২৩ সালে এসেও সড়ক মনিটরিং হচ্ছেনা। এখনো যদি সড়কে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে না আসা যায়, সড়কে যদি হাইওয়ে পুলিশের সার্বক্ষণিক টহল নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে সরকারের ডিজিটাল কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশের ভিশন কখনোই পূরণ হবেনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গৌরনদী হাইওয়ে থানায় মাত্র একটি পিকআপ ভ্যান ও দুটি মোটরসাইকেল রয়েছে। তবে নেই কোনো রেকার। আর যে পিকআপটি রয়েছে সেটিও লক্কর-ঝক্কর অবস্থা। গাড়িটির গতিসীমা ৪০ কিলোমিটারের ওপরে নিলেই ত্রুটি দেখা দেয়। পুরাতন এই গাড়িটি দিয়েই অধিক ও বেপরোয়াগতির যানবাহনের বিরুদ্ধে তাদের আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়। সেক্ষেত্রে কেউ আইন কিংবা সিগন্যাল অমান্য করলে ধাওয়া দিয়ে তাদের ধরে আইনের আওতায় আনা অসম্ভব হয়ে পরে। তাছাড়া দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতেও হাইওয়ে পুলিশকে চরম বেগ পেতে হয়। সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিলম্বের কারণে প্রায়ই জনরোষের মুখে পরতে হচ্ছে হাইওয়ে থানা পুলিশকে। পাশাপাশি নিজেদের অধীনে রেকার না থাকায় সড়কের ওপর আটকেপড়া যানবাহন সরিয়ে নিতেও অন্যের সময় ও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। গৌরনদী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ গোলাম রসুল মোল্লা বলেন, সংকট থাকলেও আমরা সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাইওয়ে মাদারীপুর জোনের পুলিশ সুপার শাহিনুর আলম খান বলেন, আমাদের বরিশাল ও পটুয়াখালী সড়ক জোনে হাইওয়ে পুলিশ স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু পদ্মা সেতুর বদৌলতে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক যাতায়াত করছে তাই প্রাথমিকভাবে কোনো ভাড়া বাসায় হলেও আমরা চাচ্ছি কার্যক্রম চালু করতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সমগ্র বাংলাদেশে প্রায় নয় হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক রয়েছে। এরমধ্যে এক তৃতীয়াংশ সড়ক হাইওয়ে পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বাকি প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার এখনো জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশ তত্ত্বাবধন করে। মূলত জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় ইউনিট না থাকায় শতভাগ সড়কপথ হাইওয়ে পুলিশ দেখভাল করতে পারেনা। সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে জনবল সংকট নিরসন ও ইউনিট বৃদ্ধি করার। জনবল ও ইউনিট বাড়লে বরিশাল বিভাগেও সকল সড়ক হাইওয়ে পুলিশের আওতায় থাকবে।