পুলিশ বলছে, চলতি মাসের শুরু থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর ১৫ স্থানে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। আর গত দুই দিনে নয়টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫০ জনকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আগুনসন্ত্রাসসহ অন্যান্য অপরাধ কঠোরভাবে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, অগ্নিসন্ত্রাস-ককটেলবাজিসহ গত কয়েকদিনের বেশ কয়েকটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এসবের সঙ্গে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের যোগসাজশ আছে।
কাকরাইলে চার্চের সামনে বিস্ফোরণে ছাত্রলীগের ক্যাডার আটক
কাকরাইলে চার্চের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই হামলার ঘটনায় ২৮ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া ঘটনাটির পর রাজধানীর সব গির্জা এবং সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।
ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম বলেন, এনসিপি কার্যালয়ের সামনে মোটরসাইকেলযোগে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত জনতা মোটরসাইকেলে থাকা মাসুদুর রহমান (২৮) এক যুবককে ধরে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। এই ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় কতজন ছিল, সব বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই যুবকের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
নাশকতার নেপথ্যে আ.লীগের ১৩ নভেম্বরের ‘লকডাউন’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ঠিক করা হবে ১৩ নভেম্বর। দিনটিকে ঘিরে ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্টদের নানা উসকানিমূলক প্রচারণা দেখা যাচ্ছে।
এরই মধ্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ১৩ নভেম্বর ‘লকডাউন’ ঘোষণা দিয়েছে। ওই কর্মসূচির ঘোষণা ঘিরে ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের গুজব ও অপপ্রচার। যার মধ্যে রয়েছে গণসমাবেশ ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার আশঙ্কা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের প্রচারণা।
গ্রেপ্তারদের কাছে পাওয়া তথ্য এবং পরিচয় যাচাই করে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। অর্থের বিনিময়ে তারা ঢাকায় এসে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণ করে এবং আবার ঢাকার বাইরে চলে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, কিছুদিন ধরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রচেষ্টা করছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে। গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ককটেল সদৃশ্য বস্তু নিক্ষেপ এবং বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোসহ আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার অপচেষ্টা অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ১৪টি ঝটিকা মিছিল করে তারা এবং স্বল্পস্থায়ী এসব ঝটিকা মিছিলের ছবি সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। অক্টোবর থেকে আজ পর্যন্ত ঝটিকা মিছিলের পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও অংশগ্রহণকারী ৫৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি। গ্রেপ্তারদের কাছে পাওয়া তথ্য এবং পরিচয় যাচাই করে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। অর্থের বিনিময়ে তারা ঢাকায় এসে ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণ করে এবং আবার ঢাকার বাইরে চলে যায়। গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হেলমেট ও মাস্ক পরে তারা ভোর বা দিনের ব্যস্ত সময়ে টার্গেটকৃত স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা এই কাজে অপ্রাপ্ত বয়স্কদেরও ব্যবহার করছে।
সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ প্রতিহত করা হবে: ডিএমপি
সাম্প্রতিক অগ্নিসন্ত্রাস-ককটেলবাজির বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস ও ককটেল বিস্ফোরণ যারা ঘটিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশ কাজ করছে। এ ছাড়া ১৩ নভেম্বরকেন্দ্রিক হুংকারের ঘটনায় যে কোনো অপরাধ কর্মকাণ্ড সঙ্গে সঙ্গে প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকায় অনেক জায়গায় একসঙ্গে একের অধিকও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এই বিস্ফোরণগুলো যারা ঘটাচ্ছে অধিকাংশই হেলমেট পরে বাইকে করে এসে ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকটি বাসে আগুন লাগানোর ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। ১৩ নভেম্বর নিয়ে ভিডিও বার্তায় যারা হুংকার দিয়েছে, সেসব ফ্যাসিবাদ গোষ্ঠীই এসব কাজ করছে। পুলিশের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে ও চেক পোস্টসহ নানা রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মাঠে র্যাব
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িসহ কয়েকটি বাসে আগুন লাগানোর ঘটনায় অলরেডি র্যাবের গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করছে। এ ছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন চার্চের সামনেসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়েও কাজ করছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের পক্ষ থেকে ১৩ নভেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শাটডাউনসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটানোর ডাক দিতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অগ্নিসন্ত্রাস, ককটেল বিস্ফোরণসহ নানা রকম অপরাধ দমনে বর্তমানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যাপক জোরদার করা হয়েছে।
র্যাবের পক্ষ থেকে ছক করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানসহ নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে, যেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে পারে ফ্যাসিবাদরা সেসব জায়গায় নিরাপত্তা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে র্যাবের আনুমানিক দুইশ পেট্রোল টহল ডিউটিতে নিরাপত্তার কাজ শুরু করেছে।
এ ছাড়া সন্ত্রাসী পর্যায়ক্রমে যেসব জায়গায় চালানো হতে পারে সেসব জায়গায় আর গতিশীল-শক্তিশালী চেকপোস্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ ও অন্যান্য স্থানে ৭০টি চেকপোস্টে কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া দেশজুড়ে র্যাবের ১৫ ব্যাটালিয়নকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক ১৩ নভেম্বর অপরাধ কার্যক্রম প্রতিরোধ ও যানবাহনে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণসহ সব রকম অপরাধ সঙ্গে সঙ্গে মোকাবিলার জন্য কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
তা ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কেউ অপরাধ ঘটিয়ে অথবা অপরাধ ঘটনার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়, এর জন্য র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সেখানে লোকবল বাড়িয়ে এক্সপার্ট সাইবার ক্রাইম টিম ২৪ ঘণ্টায় এসব মনিটরিং করছে। পাশাপাশি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অপরাধ চিত্রগুলো পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছে শেয়ার করা হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদীদের গণপ্রতিরোধের ডাক
কথিত ‘লকডাউন’ ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের এ ধরনের নাশকতা ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নানা রকমের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
এরই মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ১৩ নভেম্বর রাজপথে থাকার কথা জানিয়েছেন। ঢাকায় জাতীয়তাবাদী যুবদল আওয়ামী লীগের নাশকতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলও করেছে। ১২ ও ১৩ নভেম্বর মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির।
এছাড়া ‘জুলাই ঐক্য’ ১৩ নভেম্বর দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। আগের দিন ১২ নভেম্বর ‘শেখ হাসিনার ফাঁসি ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে’ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে বিক্ষোভ মিছিল করবে তারা।
সোমবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মীদের মোকাবিলায় বাঁশের লাঠি নিয়ে তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান।
সহিংসতা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসে আগুন ও ধর্মীয় স্থাপনাসহ কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করছে। যারা অতীতে অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বক্তব্য-বিবৃতিবাজি করেছে, তারাই এখন সে ধরনের নাশকতায় জড়িত হওয়ায় জনমনে তাদের অতীতের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
সাধারণ মানুষকে নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে সতর্ক থাকা এবং কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতার উপস্থিতি লক্ষ্য করলে একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, রাজধানীতে কয়েকটি বাসে আগুন এবং ধর্মীয় স্থাপনাসহ কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। হাজিরা দিতে এসে দিনে-দুপুরে সবার সামনে একজন ব্যক্তি সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হলেন, যা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে। অতীতে সন্ত্রাসীরা নানা ধরনের সহিংসতা সৃষ্টি করে মানুষকে আতঙ্কিত করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের সহিংস পন্থা বেছে নিয়েছে বলে উদাহরণ আছে, যা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত।
এই পরিস্থিতি যত বেশি সৃষ্টি হবে সাধারণ মানুষ তত বেশি আতঙ্কিত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে রাজনৈতিক পরিচয়সহ কোনো ধরনের বিবেচনা গণ্য না করা।
নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রশ্নে সমন্বিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন জানিয়ে ড. তৌহিদুল হক বলেন, সাধারণ মানুষকে নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে সতর্ক থাকা এবং কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতার উপস্থিতি লক্ষ্য করলে একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দায়িত্বশীল ভূমিকা সব প্রকার সংঘাত-সহিংসতা থেকে পরিত্রাণের ও প্রতিরোধের শক্তিশালী উপায়।
আপনার মতামত লিখুন
Array