পিরোজপুর শহরের টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কাজী মুজিবুর রহমান (৭৫) পিরোজপুরের শিক্ষা অঙ্গনে এক বিশেষ নাম। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, অনেকের কাছে তিনি পথপ্রদর্শক ও অনুপ্রেরণা। জীবনের আট দশকেরও বেশি সময় ব্যয় করেছেন শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার জন্য। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে শত শত শিক্ষার্থীর জীবন গড়ে দিয়েছেন তিনি।
১৯৭৪ সালে পিরোজপুর সদর উপজেলার সিকদার মল্লিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে গোপালগঞ্জ জেলার গোপিনাথপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে চার বছরের কাছাকাছি সময় শিক্ষকতা করেন। এরপর নিজ এলাকার শিক্ষা উন্নয়নে কাজ করতে চলে আসেন পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা জর্জ হাই স্কুলে। এখানে এসে এই এলাকার শিক্ষাঙ্গনে করেন অভাবনীয় পরিবর্তন।
তিনি যখন কদমতলা জর্জ হাই স্কুলে আসেন তখন এই স্কুলটি ছিল একটি কাঠের তৈরি ঘর মাত্র। সেখানেই চলত পাঠদান। এক সময় একটি ঘূর্ণিঝড়ে ঘরটি ভেঙে যায়। শুরু হয় ভবন তৈরির উদ্যোগ। তার প্রচেষ্টায় সেখানে নির্মিত হয় বিশালাকার ভবন। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, শিক্ষার মানেও আনেন অনন্য উচ্চতা। কিছুদিনের মধ্যেই পুরো জেলায় পরিচিত হয়ে যায় এই স্কুলটি। এরপর তৎকালীন জেলা প্রশাসকের অনুরোধে ১৯৯৪ সালে তিনি যোগ দেন পিরোজপুর শহরের টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ২০১১ সালে এ বিদ্যালয় থেকেই অবসরে যান এই গুণী শিক্ষক।
২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর জীবনের এক কঠিন ধাক্কায় ভেঙে পড়েন এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রিয় ছেলে কাজী মসিউর রহমান রাজীব স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রাজীবের। সহকর্মীরা জানান, ছেলেকে হারানো ছিল মুজিবুর রহমানের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।
কিন্তু দীর্ঘদিন শোকে ডুবে না থেকে ছেলের স্মৃতিকে ধরে রাখার এক ভিন্ন পথ বেছে নেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে ছেলের প্রতিষ্ঠা করা পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এখন দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান বইয়ের তাক ঘেঁটে। শিক্ষার্থীদের বই ধরিয়ে দিয়ে কিংবা পাঠাগারের কোণে চুপচাপ বসে বা কম্পিউটারে লেখালেখি করে।
শিক্ষকতায় আসার গল্প জানতে চাইলে কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, আমি পড়ালেখা শেষ করে প্রথমে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ডে (বর্তমান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড) চাকরি করি। তবে আমার বাবা চাইতেন আমি শিক্ষকতা করি। আমি ভাবলাম, শিক্ষকতার মাধ্যমে এলাকার শিক্ষা উন্নয়নে কাজ করা যাবে। তাই ১৯৭৪ সালে ওই চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা শুরু করি।
অবসরের পরে পাঠাগারের দায়িত্ব নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর আমার ছেলে কাজী মসিউর রহমান রাজীব সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। ছেলেকে হারানোর শোক আমি কখনো কাটিয়ে উঠতে পারব না। তবে তার হাতে গড়া পাঠাগারে বসলে মনে হয়, সে এখানেই আছে। যখন কোনো শিক্ষার্থী বই নিতে আসে, মনে হয় রাজীবই যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
পাঠাগারে আসা শিক্ষার্থী অথৈ আক্তার বলেন, আমরা স্যারকে প্রায় প্রতিদিনই এখানে পাই। তিনি শুধু বই দেন না, বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলেন। আমাদের মনে হয়, এই পাঠাগার শুধু স্যারের ছেলের স্মৃতি নয় আমাদের জন্যও এক আলোকবর্তিকা।
টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কাজী মুজিবুর রহমান স্যার ছিলেন এক চলমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি শুধু পড়াতেন না, প্রতিটি শিক্ষকের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা গড়ে তুলতেন। ছেলেকে হারানোর পরও তিনি যেভাবে নিজের দুঃখ ভুলে পাঠাগারে সময় দেন, তা সত্যিই অনুকরণীয়। যেখানে বইয়ের পাতায় তিনি খুঁজে পান হারানো সন্তানের সান্ত্বনা। তার জীবনটাই এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

পিরোজপুর প্রতিনিধি :
প্রকাশের সময়: রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫ । ৬:৫৭ অপরাহ্ণ