ভরা মৌসুমেও পিরোজপুরের নদীগুলোতে দেখা মিলছে না ইলিশের, হতাশায় দিন কাটছে জেলেদের। জেলেরা বলছেন, ঝাটকা ও অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে ইলিশ শূন্য হয়ে পড়েছে নদীগুলো। সঠিকভাবে যদি জাটকা রক্ষা করা না যায় আগামীতে ইলিশের ঐতিহ্য হারাবে এই জেলা।
পিরোজপুরের প্রধান বড় নদী কালীগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর আর সন্ধ্যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে সারি সারি নৌকা নিয়ে জেলেরা ইলিশ আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন, ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে কচা ও কালীগঙ্গার সুস্বাদু ইলিশ কিন্তু জেলেদের কাছে গেলেই ফুটে উঠে বাস্তব চিত্র।
দুই-তিন দিন ধরে জেলেরা জাল ফেললেও দেখা মিলছে না প্রত্যাশিত ইলিশের। মাঝেমধ্যে দু-একটা ইলিশের দেখা মিললেও আকারে খুবই ছোট হওয়ায় জেলেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। জীবিকা নির্বাহের জন্য কাঙ্ক্ষিত ইলিশের আশায় জাল ফেললেও হতাশা নিয়েই বাড়ি ফেরেন জেলেরা। দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরে কচা, কালীগঙ্গা, বলেশ্বর, সন্ধ্যাসহ বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে।
বছর কয়েক আগেও এই নদীগুলোতেই ধরা পড়ত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ কিন্তু বর্তমানে জেলেদের জালে দেখা মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশের। সম্প্রতি পিরোজপুরের কালীগঙ্গা ও কচা নদীর মোহনায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা ইলিশ আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন, কিন্তু দীর্ঘ সময় জাল ফেলে ইলিশের আশায় নির্দিষ্ট সময় পরে জাল উঠালেও দেখা পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত ইলিশের।
কয়েকজন জেলের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক দিন ধরে এভাবেই জাল ফেলছেন জেলেরা কিন্তু তাদের জালে ধরা পড়ছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। হতাশায় দিন কাটছে তাদের।
এদিকে দু-একজন কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে বলেন, পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। তার ওপরে আছে আবার এনজিওর কিস্তির চাপ। কিছু জেলেরা অবৈধভাবে মাছ ধরায় নদীতে এখন ইলিশ কমে গিয়েছে। তবে মৎস্য কর্তৃপক্ষ যদি সঠিক উদ্যোগ নেয় তাহলে আবার নদীতে মাছ পাওয়া যাবে। পিরোজপুরের ইলিশের বাজার খ্যাত বেকুটিয়া সেতুর দুই প্রান্তে বিকেল হলেই বসে ইলিশের বাজার।
পিরোজপুরের স্থানীয়রাসহ খুলনা-বরিশালগামী যাত্রীরা ইলিশের বাজার দেখে লোভ সামলাতে না পেরে ক্রয় করে থাকেন ইলিশ। বর্তমানে পিরোজপুরের নদীগুলো ইলিশশূন্য হওয়ার কারণে এ বাজারেও দেখা মেলে না ইলিশের। ক্রেতারা ইলিশ কিনতে এসে প্রায়ই ফিরে যান শূন্য হাতে। এই বাজারে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম আকাশচুম্বী। ১ থেকে দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয় ২৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩২০০ টাকা পর্যন্ত। ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ১৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ২৪০০ টাকা পর্যন্ত। যা কিনা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ না থাকায় এবং অতিরিক্ত দামের কারণে ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না এ জেলার মানুষেরা। সঠিকভাবে জাটকা সংরক্ষণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং ইলিশের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার কারণ খতিয়ে দেখার দাবি স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা বলছে, অবৈধ জাল এবং জাটকা মাছ ধরার কারণে ইলিশ শূন্য হয়ে পড়েছে এ জেলার নদীগুলো। জেলা মৎস্য বিভাগ ইলিশ সংরক্ষণে যে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে তা যথেষ্ট নয়। কয়েক বছর আগেও যে পরিমাণ মাছ জালে ধরা পড়তো এখন তার দেখা মিলে না। সারাদিন জাল ফেলেও দেখা মিলছে না ইলিশের। বাজারে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে। শুধু দামের কারণেই এই জেলার অধিকাংশ মানুষ ইলিশের স্বাদ থেকে দূরে রয়েছে।
কচা নদীতে ইলিশ ধরতে আসা মহারাজ হাওলাদার বলেন, আগে আমরা অনেক মাছ পেতাম, কয়েক বছর হলো আগের মতো মাছ পাই না। মাছ না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাধা জাল, চরগড়া, কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে বর্তমানে ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, সারাদিন জাল বেয়ে মাছ না পেয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। প্রায়ই পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। এর উপরে আবার এনজিওর কিস্তি। ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া এখন কোনো উপায় নেই। জাটকা সংরক্ষণে সরকার কঠিন পদক্ষেপ না নিলে এই নদীতে আর মাছ হবে না।
পিরোজপুরের বেকুটিয়া ইলিশ বাজারে ইলিশ কিনতে এসেছেন সাজ্জাদুর রহমান তিনি বলেন, ভেবেছিলাম এবছর ভালো ইলিশ পাওয়া যাবে এবং দামটা নাগালের মধ্যেই থাকবে কিন্তু সেরকমটা হয়নি। একে তো ইলিশ বাজারে কম তার উপরে গত বছরের তুলনায় দাম অনেক বেশি। গত বছর যে মাছ ১০০০ টাকায় কিনেছি এবছর একই ওজনের মাছ কেজি প্রতি ৬ থেকে ৭০০ টাকা বেশি। যা সাধারণ মানুষের কয় ক্ষমতার বাইরে।
বেকুটিয়া ইলিশ বাজারের ইলিশ বিক্রেতা আলামিন ইসলাম বলেন, ভরা মৌসুমেও জেলেরা ইলিশ পাচ্ছে না। যাও দু একটি ওঠে আকারে ছোট। মাঝেমধ্যে কয়েকটি মাছ পাওয়া যায় তাও তো সামান্য। গতবছর এই সময়ে যে পরিমাণ মাছ দেখেছি এ বছর তা দেখছি না। তাই দামটাও একটু বেশি।
পিরোজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্নামত বলেন, পূর্বে পিরোজপুরের নদনদীগুলোতে নাব্যতা সংকট ছিল না, এ কারণে পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা মিলতো। বর্তমানে নদীগুলোতে নাব্যতা সংকট ডুবোচর দেখা দিয়েছে এ কারণেই ইলিশের দেখা মিলছে না নদীগুলোতে। তবে জেলা মৎস্য বিভাগ ডুবোচরগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। ড্রেজিং এর এর মাধ্যমে নাব্যতা সংকট দূর হলে আবারও দেখা মিলবে ইলিশের। এছাড়াও বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে জাটকা সংরক্ষণ ও অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরা নির্মূল কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

পিরোজপুর প্রতিনিধি :
প্রকাশের সময়: রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ । ৭:৩০ অপরাহ্ণ