কেউ চাকরিজীবী, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ বা শ্রমজীবী। শুক্রবারের ছুটির দিনে সবাই ছুটে আসেন আপন গ্রামে। কেউ শহরের অফিসের কাগজ ফেলে রেখে আসেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বই-খাতা, কেউ আবার দিনের খাটুনি শেষ করে ঘরে না ফিরে চলে আসেন গ্রামের সেতুর কাছে। কেউ দিয়েছেন গাছ, কেউ দিয়েছেন টাকা।
যার কিছু নেই তিনি দিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম। উদ্দেশ্য একটাই- নিজেদের ভাঙা রাস্তাঘাট আর জরাজীর্ণ সেতু সংস্কার করা। হাতে বাঁশ, কাঠ, হাতুড়ি আর কাস্তে নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীর বলদিয়া ইউনিয়নের ফকিরবাড়ি থেকে গহররোড বাজারমুখী সড়কটি অনেকটাই খালে পড়েছে।
প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কোনো হস্তক্ষেপ না দেখে অবশেষে নিজ উদ্যোগে শুক্রবার সকালে (১২ সেপ্টেম্বর) কাঠের সেতু তৈরি শুরু করে গ্রামবাসী। ভোর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে শুরু হওয়া সেতু তৈরির কাজ দুপুর গড়াতেই শেষ হয়ে যায়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ পরপর আরো দুটি সেতু সংস্কার করেন তারা। শুধু একটি নয়, গত ১৪ দিনে অন্তত ছয়টি কাঠের সেতু সংস্কার করেছেন তারা।
একই সঙ্গে প্রায় পাঁচ শ মিটার রাস্তা ইট ফেলে মেরামত করা হয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমে সেতু নির্মাণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাইফুল ইসলাম। চাকরির সুবাদে বরিশালে থাকেন গ্রামের ছেলে সাইফুল ইসলাম। কিন্তু শুক্রবার মানেই টান পড়ে যায় বলদিয়ার গ্রামের মাটিতে। অফিসের ক্লান্তি মুছে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাঙা সেতু সংস্কারের কাজে।
সেতু আর রাস্তা সংস্কারে শুধু টাকা নয়, তিনি নিজেও শ্রম দেন। তার দেখাদেখি সমাজসেবক আলাউদ্দিন, শরীফ মাসুদ পারভেজও নামেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি শ্রমও দেন তারা। একে একে যুক্ত হন আরো অনেকে। এখন ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের দল নিয়মিত শুক্রবার হাজির হন মেরামতের কাজে।
সাইফুল ইসলাম ও শরীফ মাসুদ পারভেজ বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বনির্ভর আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই আমরা এ কাজ করছি। বলদিয়া ইউনিয়নের প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ধাপে ধাপে সংস্কার করব।
গত ২৯ আগস্ট বলদিয়ার তিনটি সেতু সংস্কার করা হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে। ব্যয়ের সিংহভাগ গেছে কাঠ কেনায়। এরপরের শুক্রবার ফকিরবাড়ি থেকে গহররোড বাজার পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শ মিটার রাস্তা ইট দিয়ে সংস্কার করেন তারা।
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকালে বলদিয়ার ফকিরবাড়ি গ্রামে দেখা যায় এক ভিন্ন দৃশ্য। কেউ হাতে কাস্তে, কেউ হাতুড়ি, কেউ বাঁশ অথবা কাঠ নিয়ে ছুটছেন। একে একে জড়ো হচ্ছেন খালে বিলীন হওয়া রাস্তার ধারে। কারো হাতে দড়ি, কারো হাতে করাত। কেউ কাঁধে করে কাঠ টানছেন, কেউ কাদামাটি মাড়িয়ে ইট ফেলছেন খালে ধসে যাওয়া রাস্তায়। মাথার ঘাম ঝরে পড়ছে বৃষ্টিস্নাত মাটিতে। অথচ কারো মুখে ক্লান্তি নেই বরং ঠোঁটের কোণে হাসি। কারণ নিজের গ্রামকে বাঁচানোর চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে! দুপুরের মধ্যেই তৈরি হলো নতুন কাঠের সেতু।
নতুন সেতু পার হচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এনামুল হক রতন। তিনি জানান, তার বাসার পাশের একটি ভাঙা টয়লেটের ইট খুলে নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। এখন ওই পথে যানবাহন চলাচল করছে। এবার ১২ সেপ্টেম্বর হলো নতুন সেতু।
বলদিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে ৬০ ফুট দীর্ঘ একটি সেতু। প্রতিদিন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা জীবন হাতে নিয়ে সেটি পার হত। কারো পা পিছলে গেলে পানির স্রোতের হারিয়ে যাওয়ার ভয়। গত শুক্রবার গ্রামবাসীর শ্রমে সেই সেতুত দেওয়া হয়েছে কাঠের ছাউনি। এতে সেতু থেকে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমেছে।
সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আগে ভয় পেতাম। সেতু দিয়ে হাঁটতে গেলে বুক ধড়ফড় করত। এখন মনে হচ্ছে নতুন রাস্তা পেলাম।’
বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদুল ইসলাম সাইদ বলেন, ‘এলাকার যুবসমাজ অন্তত ৭টি সেতু সংস্কার করেছেন স্বেচ্ছাশ্রমে। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের পাশের সেতুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামবাসীরা আমাদের লিখিতভাবে জানালে অন্য কোনো ফান্ড থেকে বড় ব্রিজটি সংস্কারের ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত অনুমতি নিয়েই স্বেচ্ছাশ্রমে কাঠের সেতু সংস্কার চলছে।’

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময়: সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ । ৮:০৮ অপরাহ্ণ