বরগুনায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ৩০ কোটি টাকার তিন প্রকল্প

বরগুনা প্রতিনিধি :
প্রকাশের সময়: সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫ । ৮:১৯ অপরাহ্ণ

বরগুনা পৌরসভায় প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিনটি প্রকল্প সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসছে না। রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়িত এসব প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা।

তাদের অভিযোগ, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে প্রকল্পগুলো অচল হয়ে পড়েছে, ফলে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

বরগুনা শহরের বর্জ্য সমস্যা নিরসনে সদর ইউনিয়নের পিটিআই এলাকায় প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে সার উৎপাদনের কথা থাকলেও উদ্বোধনের চার বছর পরও এটি চালু করা যায়নি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পটি অকার্যকর অবস্থায় পড়ে থাকায় বিপাকে পড়েছেন আশপাশের বাসিন্দারা। স্থানীয় অধিবাসী কালাম বলেন,

বর্জ্য পরিশোধনাগারের ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে পুরো এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়েছে। এখন ঘরে ঘরে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।

অন্য বাসিন্দা সালেহ বলেন, ‘এখানে সার উৎপাদন করার কথা ছিল, কিন্তু তারা এখন পরিবেশ দূষণ করছে। এ কারণে হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। আমরা অত্যন্ত দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি এই বর্জ্য পরিশোধনাগারের কারণে।’

শহরের পানির সংকট নিরসনে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি উঁচু জলাধার নির্মাণ করা হয়। এ দুটি জলাধারের ধারণক্ষমতা ২০ লাখ লিটার। কিন্তু নাগরিকদের অভিযোগ, প্রকল্পগুলো কেবল প্রদর্শনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, জনসেবায় কোনো সুফল মিলছে না।

ব্যাংক কলোনী এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন বলেন, ‘আমাদের পানির সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে। যে পরিমাণ পানি আমাদের প্রয়োজন তা আমরা পাই না। পানির স্পিড কম থাকায় নামে মাত্র পানি পাচ্ছি। ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত উঁচু জলাধার থেকে কোনো সুফল আমরা পাইনি।’

কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, আমার বাসার সামনে একটি উঁচু জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। বেশ কয়েকবার এটি চালুর চেষ্টা হলেও কার্যকর করা যায়নি। মূলত এটি একটি সম্পূর্ণ লস প্রজেক্ট। আমাদের জানানো হয়েছে, এটি আদৌ চালু করা সম্ভব নয়।

প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পৌর অডিটরিয়ামের কাজ ২০২০ সালের আগস্ট থেকে বন্ধ রয়েছে। পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, ভৌত কাঠামোর মাত্র ৫৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হলেও ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৬৮ শতাংশ বিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়েছে। এ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অসম্পূর্ণ ভবনে এখন অসামাজিক কার্যকলাপের পাশাপাশি মাদকসেবীদের আখড়া গড়ে উঠেছে।

চরকলনী এলাকার বাসিন্দা ছগির হোসেন টিটু বলেন, অর্ধনির্মিত কমপ্লেক্স ভবনটি অরক্ষিত থাকার কারণে মাদকসেবীদের আড্ডা বসছে। ভবনটি পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি নির্মাণ শেষ করে চালুর কোনো উদ্যোগ নেই।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এসব প্রকল্প জনস্বার্থে নয়, বরং ব্যক্তিস্বার্থে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি, ফলে প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুরাদ খান বলেন, ‘সরকারি অর্থ অপচয়ের এই নজির প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতিফলন।’ বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মো. সালেহ বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম না হলে আজ জনগণ এর সুফল ভোগ করত।

জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘অপরিকল্পিত প্রকল্প ও লোপাটের দায় সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। জড়িতদের আনতে হবে আইনের আওতায়।’

বরগুনার পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘অপরিকল্পিত এই প্রকল্প তিনটি লুটপাটের কারণে এমন অবস্থায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষের বিষয়টি দুদকের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা উচিত এবং আইনগত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

বরগুনা পৌরসভার প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘এই প্রকল্পের কোনো কাগজপত্র আমাদের কাছে নেই। প্রকল্পগুলো যে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে আমরা কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারছি না।’

প্রকাশক ও সম্পাদক: মেহেরুন্নেছা বেগম।  কপিরাইট © ২০২৫ দৈনিক আজকের বার্তা সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

প্রিন্ট করুন