লবণাক্ত জমি থেকে ‘সবজি রাজ্য’, সওদাগরপাড়ায় এখন কৃষির বিপ্লব

স্টাফ রিপোর্টার :
প্রকাশের সময়: রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫ । ৮:৩২ অপরাহ্ণ

স্টাফ রিপোর্টার : বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া গ্রাম একসময় ছিল চরম লবণাক্ততার শিকার। নদী ও সাগরের সংস্পর্শে থাকা পাঁচ হাজার একরের বেশি জমিতে বছরে কেবল আমন ধানই হতো, বাকি সময় জমিগুলো পড়ে থাকতো অনাবাদি। কিন্তু আজ সেই ছবিটা বদলে গেছে। এখন ২৭৫ একর জমিতে বছরজুড়ে হয় সবজি চাষ। একে ঘিরে বদলে গেছে এলাকার কৃষি, জীবিকা ও অর্থনীতি। জন্ম নিচ্ছে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনাও।

‘কান্দি পদ্ধতি’ বদলে দিল সব
এই কৃষি বিপ্লবের নেপথ্যে আছেন গ্রামেরই একজন কৃষক, শাহাদাত হোসেন মাতুব্বর। তিনি উদ্ভাবন করেন বিশেষ এক চাষপদ্ধতি, যার স্থানীয় নাম ‘কান্দি’।

এই পদ্ধতিতে জমির চারপাশের মাটি কেটে মাঝখানে উঁচু বেড তৈরি করা হয়। এতে লবণাক্ততা কমে, আর বৃষ্টির পানি জমে সেচের কাজে লাগে। শাহাদাতের ভাষায়, বেড সমতল থেকে সাড়ে তিন ফুট উঁচু, তাই লবণ ছড়াতে পারে না। এখন বোরো ধানও হয়।

এই পদ্ধতির মাধ্যমে বর্তমানে শতাধিক কৃষক বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। ধান ছাড়াও হচ্ছে পেঁপে, কলা, বেগুন, লাউ, সূর্যমুখীসহ বিভিন্ন সবজি ও ফলের চাষ।

ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে কৃষিতে সফল রাসেল
গ্রামেরই আরেক তরুণ ইমরান হোসেন রাসেল নিজের জীবনে বড় ঝুঁকি নিয়ে সফল হয়েছেন কৃষিতে। এক সময় ব্যাংকে চাকরি করতেন, পরে তৈরি পোশাক সরবরাহ ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ব্যবসায় বড় ক্ষতির পর ফিরে আসেন নিজ গ্রামে।

পারিবারিক ২৪ একর জমিতে শুরু করেন মাছ ও সবজি চাষ। এখন তার বাৎসরিক আয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। রাসেল বলেন, পুকুরপাড়ের অব্যবহৃত জমিতে সবজি চাষ করছি। এটি সাপ্তাহিক আয়েও সাহায্য করছে। শাহাদাত হোসেনের সহযোগিতায় আরো আধুনিকভাবে কৃষিকে এগিয়ে নিচ্ছেন তিনি।

গ্রামে ফিরছে মানুষ, বাড়ছে আয়
শুধু রাসেল নন, অনেকেই শহর ছেড়ে ফিরছেন গ্রামে। যেমন, সামসুল হক যিনি ১০ বছর আগে কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। এখন গ্রামে ফিরে বছরে প্রায় ছয় লাখ টাকা আয় করছেন সবজি চাষ থেকে। কলেজছাত্র বায়েজিদ লেখাপড়ার পাশাপাশি আড়াই বিঘা জমিতে সবজি চাষ করছেন। বছরে আয় করছেন চার লাখ টাকা। নারীরাও যুক্ত হচ্ছেন চাষাবাদে। ফলে শুধু কৃষিই নয়, পুরো গ্রামে তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সুযোগ। স্থানীয় কৃষক মিজান পঞ্চায়েত বলেন, আগে বিকল্প কাজের জন্য শহরে যেতাম, এখন আর যেতে হয় না। গ্রামের মধ্যেই বছরে চার-পাঁচ লাখ টাকা আয় করছি।

কৃষি ও পর্যটনের সমন্বয়
তালতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু জাফর মো. ইলিয়াস জানান, বর্তমানে সওদাগরপাড়ায় ২৭৫ একর জমিতে কান্দি পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। প্রায় ২০০ কৃষক এই কাজে যুক্ত। বছরে প্রায় ১০০ মণ সবজি উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। এলাকার এই সাফল্য পর্যটনেরও দরজা খুলে দিচ্ছে। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, শহর থেকে মানুষ আসছে খেত দেখতে, ছবি তুলছে, সন্তানদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে আসছে। কৃষক টুটুল মিয়া বলেন, শহরের মানুষ আসছে, খেত ঘুরছে। চাই এটার প্রসার হোক।

জল তরণী পর্যটন সংস্থার পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, ‘এটা এক ধরনের অ্যাগ্রো-ট্যুরিজম। উপকূলের লোনা জমিতে কৃষি ও পর্যটনের সংযোগ এখনো নতুন বিষয়। কিন্তু এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে চাইলে এখনই প্রয়োজন স্থানীয় সরকার ও জেলা পর্যটন বিভাগের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। গেস্ট হাউস, নৌকা ভ্রমণ, পর্যটক সুবিধা থাকলে এটি জেলাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

 

প্রকাশক ও সম্পাদক: মেহেরুন্নেছা বেগম।  কপিরাইট © ২০২৫ দৈনিক আজকের বার্তা সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

প্রিন্ট করুন