৫০০ কারখানায় কাঠের গন্ধ, খালে নৌকার সুর

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময়: রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫ । ৭:৩২ অপরাহ্ণ

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির বলদিয়া ইউনিয়নের ডুবি গ্রাম। গ্রামে ঢুকতেই মনে হয় যেন এক বিশাল খোলা কর্মযজ্ঞ। বাতাসে ভাসছে তাজা কাঠের গন্ধ, খালে ভাসছে নতুন নৌকা। খালের ধার ঘেঁষে সারি সারি কারখানা—কোথাও কাঠ কেটে মাপ নেওয়া হচ্ছে, কোথাও বসানো হচ্ছে নৌকার পাটাতন।

উঠানে নৌকা, বারান্দায় নৌকা, এমনকি রান্নাঘরেও নৌকা—এ যেন গ্রামজুড়ে নৌকার উৎসব। এই উৎসব চলে সারা বছর, তবে বৈশাখ থেকে কার্তিক পর্যন্ত থাকে সবচেয়ে বেশি জমজমাট। তখন স্কুলগামী শিশুরাও হাত লাগায় নৌকা তৈরির কাজে। বর্ষায় এখানকার কর্মচাঞ্চল্য যেন দ্বিগুণ হয়।

খাল-বিলের গ্রামগুলোতে যাতায়াতের প্রধান ভরসা নৌকা। আর নৌকা তৈরির সবচেয়ে বড় কেন্দ্র এই ডুবি গ্রাম। স্থানীয়দের দাবি, গ্রামজুড়ে রয়েছে প্রায় পাঁচ শ ছোট-বড় নৌকা কারখানা, যেখানে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকা। পেয়ারা সংগ্রহ থেকে বাজারজাতকরণ—সবই হয় এই নৌকায় করে।

আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা চাষিরা এই নৌকা ব্যবহার করেন, আর আশপাশের বিল অঞ্চলের মানুষ বছরের দুই-তৃতীয়াংশ সময় যাতায়াত করে এগুলোয় ভরসা করে।

প্রায় এক শতাব্দী আগে খালকেন্দ্রিক জীবনযাপন টিকিয়ে রাখতে এখানকার মানুষ শুরু করেছিল নৌকা বানানো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই ধারা আজও চলছে। শুধু নৌকা তৈরিই নয়, গড়ে উঠেছে শতবর্ষী নৌকার হাটও। প্রতি শুক্রবার সেখানে শত শত নৌকা বিক্রি হয়।

স্থানীয়দের মতে, বছরে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয় এই হাটে।
নৌকা তৈরির প্রধান উপকরণ কাঠ, আর সেই কাঠের সবচেয়ে বড় বাজার স্বরূপকাঠির ইন্দুরহাটে। সন্ধ্যা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই কাঠের হাট।

ডুবি গ্রামের প্রবীণ কারিগর আব্দুল বারেক বলেন, ‘আমার দাদা আশ্বেদ আলীর হাত ধরে এই গ্রামে নৌকা বানানো শুরু হয়। তখন সুন্দরবনের শাল, সেগুন আর সুন্দরী কাঠ দিয়ে একটি নৌকা বানাতে দুই সপ্তাহ লেগে যেত। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করতাম। বাবা আতাহার আলীও ছিলেন নৌকার কারিগর। বাবার কাছ থেকেই পাঁচ ভাই এই পেশায় হাতেখড়ি নিয়েছি। এখন যন্ত্রপাতি বদলেছে, কাঠ বদলেছে, কিন্তু হাতের কাজের টান আগের মতোই আছে। এখন দুজন মিলে এক দিনে একটি নৌকা তৈরি হয়ে যায়।’

কারিগর কবির হোসেন জানান, বর্ষাকালে বরিশালের আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, নাজিরপুর এবং গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে নৌকা ছাড়া চলাচল প্রায় অসম্ভব। মৌসুম এলেই চাহিদা এত বেড়ে যায় যে অর্ডারের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। বিশেষ করে স্বরূপকাঠি, বানারীপাড়া ও ঝালকাঠির পেয়ারা চাষিরা নৌকায় করে বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করেন এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছে দেন।

ডুবি গ্রামের অন্তত ২০ জন কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি কারখানায় ৩-৫ জন মিস্ত্রি নিয়মিত কাজ করেন। রেইন্ট্রি, চাম্বল ও কড়াই কাঠ দিয়েই তৈরি হয় নৌকার গা। ১৮ ফুট লম্বা ছোট নৌকা বানাতে দুজনের লাগে এক দিন, মাঝারি নৌকা শেষ হতে লাগে দুই দিন। নকশা করা নৌকা তৈরি করতেও কেউ কেউ পারদর্শী। বায়না ছাড়া সাধারণত নৌকা বানানো হয় না; অর্ডারের নৌকা তৈরিতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ।

বাজার থেকে কাঠ কিনে স্ব-মিলে চেরাই করিয়ে কারখানায় আনা পর্যন্ত সব কাজ নিজেরাই করেন কারিগররা। কাঠের ধরন অনুযায়ী দামের তারতম্য হয়—ছোট নৌকা বিক্রি হয় ২,৮০০ টাকায়, মাঝারি নৌকা ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে আটঘর-কুড়িয়ানার হাটে নিয়ে যান, যেখানে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৫০০ থেকে ৪,৫০০ টাকা। বর্ষায় চাহিদা বেশি থাকায় দাম আরো বেড়ে যায়। প্রতিটি নৌকা বিক্রিতে খরচ বাদ দিয়ে কারিগররা গড়ে ৫০০ টাকা লাভ পান।

ডুবি গ্রামের শত শত পরিবার প্রজন্ম ধরে এই পেশায় জড়িত। বর্ষাকালে গ্রামটির অর্থনীতিতে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। তবু সরকারি নিবন্ধন না থাকায় তারা সুবিধাবঞ্চিত, এমনকি সরকারি আর্থিক সহায়তাও পান না।

৩০ বছর ধরে নৌকা বানানো মাসুম মিস্ত্রি জানান, বৈশাখ থেকে কার্তিক পর্যন্ত মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে তিনি ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, যা সুদসহ ৪৬ কিস্তিতে পরিশোধ করতে গিয়ে এখন আর্থিক চাপে আছেন। সরকারি সহজ শর্তের ঋণ সুবিধা থাকলেও বিসিকে গিয়ে দেখেছেন, সেখানে একজন সরকারি কর্মচারীর সুপারিশ ছাড়া ঋণ পাওয়া যায় না। সেই জামিনদার জোগাড় না করতে পারায় তিনি সরকারি সহায়তা পাননি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পিরোজপুর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক এইচ এম ফাইজুর রহমান জানান, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু আছে, তবে ঋণ পেতে সরকারি একজন কর্মচারীর জামিনদার থাকতে হয়। এ কারণে ডুবি গ্রামের কারিগরেরা ৬ শতাংশ সুদে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার ঋণ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ৫০০ পরিবারের দুই হাজারের বেশি মানুষ সরাসরি এই পেশায় জড়িত। কালের কণ্ঠ

 

প্রকাশক ও সম্পাদক: মেহেরুন্নেছা বেগম।  কপিরাইট © ২০২৫ দৈনিক আজকের বার্তা সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

প্রিন্ট করুন