‘বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ শিকার করতে থাকলে এক সময় সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে এবং উদ্ভিদ-জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ ধংস হয়ে যাবে। ’ ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কাঁকড়া পরিবহন নিয়ে এক রায়ে এমন মন্তব্য করেছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ের অনুলিপি সাম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। রায়ের নির্দেশনায় আদালত বলেন, বিষ দিয়ে মাছ শিকার করলে কিংবা চারু পদ্ধতির মাধ্যমে কাঁকড়া শিকার করলে ওই নৌকার সব আরোহীকে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
আদালতে রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন আল ফয়সাল সিদ্দিকী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
অ্যাডভোকেট আল ফয়সাল সিদ্দিকী জানান, নিবন্ধিত ট্রলারে পশুর নদী ব্যবহার করে দুবলার চর থেকে সব ধরনের মাছ পরিবহনের অনুমতি আছে বন বিভাগের। তবে কাঁকড়া বহনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। ফলে কাঁকড়া ধরার পর খুলনা আনতে দেরি হওয়ায় অনেক কাঁকড়া মারা যেতো। এ অবস্থায় অন্যান্যদের মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি চেয়ে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট প্রধান বন সংরক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করেন দাকোপ ও বটিয়াঘাটাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাঁকড়া আহরণকারী জেলেরা। কিন্তু বন বিভাগ ওই আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় জেলেরা ওই বছরই হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট ৩০ দিনের মধ্যে ওই আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।
এরপর বন বিভাগ থেকে ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর আবেদনকারীদের জানান যে, কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এরপর বন বিভাগের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে জাহান আলী গাজীসহ ৮ জনের ২০১৯ সালে রিট আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রায় দিলেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, এক শ্রেণীর জেলে সুন্দরবন বিভাগ থেকে মাছ আহরণ করার জন্য পাস সংগ্রহ করেন। পরে তারা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ আহরণ করে থাকেন। ফলে বিষ প্রয়োগ করা খালে সব ধরনের উদ্ভিদ-জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায়। এমন কাজ অত্যন্ত নিকৃষ্ট। এমন বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ আহরণ করা অব্যাহত থাকলে এক সময় সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।
হাইকোর্টের রায়ের সাত দফা নির্দেশনাগুলো: ১. রিটকারীরাসহ কাঁকড়া জেলেরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুন্দরবনের সংশ্লিষ্ট স্টেশন অফিসে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে পাস (অনুমতি) সংগ্রহ করে কেবলমাত্র বৈঠা চালিত নৌকা এবং ‘দোন দড়ি’র মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজনের কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন। ২. কোনো অবস্থাতেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত এলাকার খালের ভেতরে কোনো ধরনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার চলাচল করা যাবে না। এজন্য বন বিভাগসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে চলাচলকারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। ৩. পাস নিয়ে কাঁকড়া আহরণের জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় বন বিভাগের স্টেশন অফিস থেকে কঠোরভাবে সংশ্লিষ্ট নৌকা ও নৌকার লোকদের পরীক্ষা করতে হবে। যাতে কোনো ধরনের ‘চারু (কাঁকড়া ধরার জন্য বাঁশের শলা দ্বারা নির্মিত চাই যা স্থানীয়ভাবে চারু নামে পরিচিত) এবং ‘বিষ’ কিংবা অন্য কোনো বেআইনি জিনিস বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে। এক্ষেত্রে দিনের বেলায় তাদের নৌকা পরীক্ষা করে সুন্দরবনের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া সমীচীন হবে।