আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

বরিশালে সীমানা পিলার ছাড়া নদীগুলো বাঁচানো কঠিন


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২১ ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ বরিশালে সীমানা পিলার ছাড়া নদীগুলো বাঁচানো কঠিন
Spread the love

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

কীর্তনখোলা তো বটেই, জেলার ২৩টি নদীর পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে নানা পক্ষ। দখলদারদের তালিকায় প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই প্রভাবশালী নেতারা আছেন। এদের মদতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধিদের ছোটবড় অনেক সংগঠনের নেতারাও সমানতালে দখল করছেন নদী।

অভিযোগ উঠেছে, সিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী কীর্তনখোলা নদীর প্লাবন ভূমি সুরক্ষায় তীর ভূমি (ফোরসোর) এলাকায় স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন করা হচ্ছে না। এ ছাড়া অবৈধ দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করে উচ্ছেদসহ জরিমানা আদায় করা হচ্ছে না বলেও বাড়ছে দখলদারের সংখ্যা, বিলুপ্ত হতে চলেছে জেলার নদীগুলো।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮০০ সালের দিকে ডিস্ট্রিক কালেক্টর হেনরি বেভারেজের উদ্যোগে কীর্তনখোলাকে ভাঙন থেকে বাঁচাতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ওই বাঁধের ওপর হয়েছে সড়ক। এ সড়ক সংলগ্ন এলাকায় চর পড়তে শুরু করলেই প্রভাবশালীরা নদী থেকে বালু তুলে চরের জমি বাড়াতে থাকে। পোর্টরোড থেকে স্টেডিয়াম হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস পর্যন্ত বিস্তৃত এ সড়ক। এর প্রায় দুই কিলোমিটার এবং নদীর পাড় পর্যন্ত চওড়ায় ৫০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটার এলাকা আগেই দখল হয়েছে। এখনও দখল চলছে। দখলের আগে কীর্তনখোলার চওড়া ছিল এক কিলোমিটার। যা এখন গড়ে ৩০০ মিটারে দাঁড়িয়েছে।

এ ছাড়া আশির দশকে নগরীর প্রান্তে কীর্তনখোলার ২৩ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে রসুলপুর চর। এরপর যে দলই ক্ষমতায় এসেছে তাদের ছত্রছায়ায় চর সংলগ্ন নদী দখল করে প্রভাবশালীরা সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম চর। সেই ২৩ একরের রসুলপুর এখন ৫০ একর হয়েছে। বহুতল ভবন থেকে শুরু করে মাছের ঘের, মুরগির ফার্ম, বালুর প্রতিষ্ঠান, ডকইয়ার্ড এবং ছোট ছোট ঘরও হয়েছে সেখানে। এমনকি প্লট আকারে বিক্রিও হচ্ছে দখল করা জমি।

একইভাবে বালু ফেলে কীর্তনখোলার বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার, কর্ণকাঠী, পলাশপুর, খোন্নারের চর এবং চর বাড়িয়ার চরের পরিসর বাড়ানো হচ্ছে। খোন্নারের চরে এখন দু’টি ইটভাটাও আছে। প্রশাসন কঠোর না হওয়ায় চর ছাড়াও আরও অন্যসব নদীর তীর দখল করে নির্মিত হচ্ছে পাকা স্থাপনা।

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সালে বরিশাল নদীবন্দর প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর কীর্তনখোলার পানির স্তর থেকে স্থলভাগের দিকে জমির ৫০ গজ পর্যন্ত মালিকানা বিআইডব্লিউটিএ’র। সেই অনুযায়ী নৌ-বন্দরের উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৩৭ একর জমি বিআইডব্লিউটিএর। তবে ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর না থাকায় বিভিন্ন সময় ভূমিখেকোরা গড়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতঘর।

সম্প্রতি রসুলপুর চরের আট একরেরও বেশি জমি এবং জেলখাল থেকে এপিবিএন দফতর পর্যন্ত কীর্তনখোলার তীরের ২৮ একর জমির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ দখল হয়ে গেছে।

ভূমিহীনদের সংগঠন কৃষক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) এবং বরিশাল জেলা সভাপতি হারুন ভান্ডারী বলেন, ২০২০ সালে কীর্তনখোলার তীর থেকে শুরু করে চর দখলে জড়িতদের একটি তালিকা করে বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছিল। ওই তালিকায় ৩১ প্রভাবশালী ভূমিদুস্যর নাম উল্লেখ করে তাদের ঠিকানাও দেওয়া হয়েছিল।পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। অভিযান না থাকায় প্রতিদিন দখলদার বাড়ছে বলে অভিযোগ তার।

হারুন ভান্ডারী আরও বলেন, নগরীর বেলতলায় নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। সেটা এখন ভাঙনের মুখে। তীর ঘেঁষে সিটি করপোরেশনের নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা পার্কও নদী দখল করে তৈরি করা। ইতোমধ্যে জেলার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

‘নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলন’-এর সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, কীর্তনখোলার পাড়ে যা কিছু আছে সবই অবৈধ।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মূলত নদী শাসনের পুরোটাই জেলা প্রশাসনের অধীনে। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের বিষয়টি বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে। সিটি করপোরেশনকে দরকার হলে আমরা শতভাগ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে। বিআইডব্লিউটিএ মূল বিষয়টি দেখে। তারা যখনই প্রয়োজন মনে করবে আমাদের সহযোগিতা নিতে পারবে। সীমানা পিলারের বিষয়টিও তাদের এখতিয়ারে।’

বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল বন্দর ও পরিবহন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। তালিকা প্রণয়নের কাজ শেষ। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথ জরিপের কাজ করোনার কারণে শেষ হয়নি। এ কাজ শেষ হলেই দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সীমানা পিলারও স্থাপন হবে।’

বাপা’র সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ‘নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং নদী রক্ষায় ২৩টি সুপারিশমালা রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলো হলো উচ্চ আদালতের রায়ে সিএস মৌজা অনুযায়ী কীর্তনখোলার প্লাবন ভূমি সুরক্ষা (জোয়ারের সময় যে পর্যন্ত নদীর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে); তীর ভূমি এলাকা রক্ষা (ঢেউ আছড়ে পড়ার পর থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত এলাকা, ইংরেজিতে যাকে বলে ফোরসোর) জেলার সকল নদী, শাখা-নদীর সিএস মৌজা ম্যাপ অনুসরণ করে ডাটাবেজ তৈরি; সিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী নদীর তীরবর্তী স্থানে স্থায়ী পিলার স্থাপন ও দখলদার উচ্ছেদ করে জরিমানা আদায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘লঞ্চ মালিক ও সংশ্লিষ্ট দফতরের সমন্বিত উদ্যোগে ক্যাপিটাল ড্রেজিং-এর মাধ্যমে নদীর সঙ্গে শাখানদী ও খালের উৎসমুখ সচল করার উদ্যোগও নিতে হবে। সরকারের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ পরিকল্পনা অনুযায়ী নদীকে তার নিজের মতো প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জাতিসংঘ পানি প্রবাহ আইন-১৯৯৭ অনুস্বাক্ষর করার মাধ্যমে উজানের নদীর পানির অববাহিকা ভিত্তিক সংকট নিরসন এবং জয়েন্ট রিভার কমিশনকে সক্রিয় করার মাধ্যমে উজানের অববাহিকাভিত্তিক পানির ন্যায্য হিসাব আদায়ের মাধ্যমে প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগও নিতে হবে।’

২০১৯ সালের ২৩ মে বরিশালে অবৈধভাবে দখল হওয়া নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের তালিকা চেয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি পাঠান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। এরপর দখলদারদের তালিকা পাঠান জেলা প্রশাসক। সেই হিসাবে জেলায় দখলদার আছে প্রায় ২১৪৮ জন। এর মধ্যে বরিশাল সদর উপজেলায় ২৯৩ জনের মধ্যে কীর্তনখোলার দখলকারীই আছে ১২৩ জন। সবচেয়ে বেশি দখলকারী থাকে আগৈলঝাড়া উপজেলায়। তালিকায় ওই উপজেলার এক হাজার ৮২ জনের নাম পাওয়া গেছে। গৌরনদী উপজেলার অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা ২৭৩ জন। বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ১৮৬ জন, উজিরপুরে ৫৯ জন, মুলাদীতে ১০৯, মেহেন্দিগঞ্জে ৭৩ ও বানারীপাড়ায় দখলদার আছে ৭৩ জন।