কলাপাড়া প্রতিনিধি ॥
কলাপাড়ায় ঘরে ঘরে বিদ্যুত সুবিধায় কর্মসংস্থান ১০ হাজার মানুষের ॥ বেড়েছে দৈনিক কর্মঘন্টা ॥
দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার ৩৫ বছর বয়সী রাসেলের। চার বছর আগেও রাত আটটার আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে যেতেন। কৃষিকাজের বাইরে কিছুই করতেন না। এখন রাত ১২ টা পর্যন্ত জেগে কাজ করছেন, নিজের দোকানে।
স্ইাকেল, অটোবাইক, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন মেরামতের পাশাপাশি চাকায় হাওয়া দেয়ার কাজ চলে তার দোকানে। এখন তার কর্মঘন্টা বেড়েছে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা বেশি কাজ করছেন। বেড়েছে উপার্জনও। চম্পাপুরের বাংলাবাজার এলাকায় রাসেলের মতো আরও ২৫-৩০ দোকানির এখন বেড়েছে বেচা-কেনা। বেড়েছে কর্মঘন্টা। ঘরে ঘরে বিদ্যুত আর রাস্তাঘাটের উন্নয়নের এসব মানুষের পেশায় উন্নতি হয়েছে। হয়েছে পরিবর্তন। যেন দিন বদলের পালে হাওয়া বইছে। সন্ধার পরে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকা এইসব জনপদে এখন মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানপাটে বিদ্যুতের আলোয় হাট-বাজার থাকছে আলোকিত। বাড়িঘরের সামনেও জ¦লে বিদ্যুতের আলো।
রাস্তার হাট-বাজারে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি দোকানপাটে চলে বেচাকেনা। চায়ের তৃষ্ণা মেটানোর জায়গায় কফির আড্ডা বসে। ডিসের বদৌলতে দেখেন দেশ-বিদেশের খবরা-খবর, আগে খবর শুনতেন। আর এখন দেখেন। সাগরপারের কলাপাড়া উপজেলার ১২ টি ইউনিয়ন আর দুই টি পৌরসভার ২৪৭টি গ্রামের দৃশ্যপট এক। যেখানেই পাকা সড়ক রয়েছে সেখানের হাঁট-বাজার আর গ্রোথ সেন্টারকে ঘিরে বসেছে বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট। মানুষ তাঁদের সকল নিত্যপণ্য বাড়ির কাছেই পাচ্ছেন। তেগাছিয়া, বাবলাতলা বাজার এলাকা দশ বছর আগেও ছিল অনগ্রসর জনপদ। সবগুলোর একই দৃশ্যপট। মানুষ খালি পায়ে হেটে আসত বাজারে। এখন অটোবাইক কিংবা মিশুকে চড়েই কাছের বাজারটিতে চলে যাচ্ছেন। এসব বাজারে কী নেই। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক কোম্পানির শো-রুম পর্যন্ত বসেছে। টিভি-ফ্রিজ পর্যন্ত বেচা-কেনা চলছে। হয়েছে চিকিৎসা সেবার ক্লিনিক। বসছে এমবিবিএস চিকিৎসক। মানুষ যেন গ্রামেই পাচ্ছেন শহরের সেবা।
শুধু তাই নয়, কুমিরমারা গ্রামের সবজি চাষী গাজী জাকির হোসেন জানালেন, ১১ মাস আগে বিদ্যুত পেয়েছেন। এখন স্বাচ্ছন্দে বসবাস করছেন। কৃষিতেও এর সুফল মিলছে। আগে রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। এখন সন্ধ্যার পরে ক্ষেতের সবজি তুলে এনে বাড়িতে বসে সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত বাছাই করে পরের দিন খুব সকালে বাজারে নিতে পারেন। গবাদিপশু পালনে আগে সোলার বাতি দিতে হতো। এখন কারেন্টের বাতি দেন। ফ্যানের ব্যবস্থাও থাকছে। গবাদিপশুর স্ট্রোকে আক্রান্তের ঝুঁকি কমছে। গবাদিপশু, হাস-মুরগির পালনে আগ্রহ বাড়ছে গ্রামের মানুষের। এ ছাড়া কৃষিতে পোকামাকড় দমনের জন্য বিদ্যুত খুব ভালো কাজে আসছে। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পরে পুকুরে আলোর ফাঁদ দেই বাল্ব জ¦ালিয়ে। এতে ক্ষেতের পোকা পুকুরে পড়ছে। কমছে পোকার উপদ্রব। অপরদিকে পুকুরে পোকামাকড় মাছের খাবার হিসেবে কাজে আসছে। যেখানে একটি পুকুরে মাসে এক মন খাবার লাগত, সেখানে এখন লাগছে ১০-১৫ কেজি। যেন মানুষ বিদ্যুতের আলোয় নিজের জীবিকার অন্ধকার পথে আলো দেখছেন। মানুষটির গড়ে আগের চেয়ে প্রতিদিন ৪/৫ ঘন্টা কাজ বেড়েছে।
বালিয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবিএম হুমায়ুন কবির জানান, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার ফলে তার ইউনিয়নের অন্তত এক হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। শতাধিক মানুষ অটোবাইক চালানোর সুযোগ পেয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে নারী-পুরুষ দোকান করছেন। হাঁস-মুরগীর খামার করেছেন। অনেক রাত অবধি সেলাই মেশিন চালাতে পারছেন। মিঠাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী হেমায়েত উদ্দীন হিরণ জানান, বিদ্যুত সুবিধা পেয়ে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসার ঘটেছে। তার ইউনিয়নের তেগাছিয়া বাজারে ওয়াল্টন কোম্পানির শো-রুম পর্যন্ত করা হয়েছে। বিদ্যুত চালু হওয়ায় এর মেরামতের কাজ করেও ১৫/১৬ জনের জীবন -জীবিকা চলছে। ধুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল আকন জানান, তার ইউনিয়নে বিদ্যুত চালু হওয়ায় অন্তত সহ¯্রাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এভাবে উপজেলার ১২ টি ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে শুধুমাত্র ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার ফলে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তো বিদ্যুত সুবিধায় লেখাপড়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে। চরচাপলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন জানায়, অনন্তপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। দুই বছর আগে বিদ্যুত সুবিধা পৌছেছে। এর ফলে রাতে পর্যাপ্ত আলোয় লেখা-পড়া করতে পারছে। করোনাকালে অনলাইনে ক্লাশ করার সুযোগ পেয়েছে। সংসদ টিভিতে পাঠদানের সহায়তা পাওয়া গেছে। এক কথায় গ্রামে থেকে শহরের সকল সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি এই শিক্ষার্থীর। ফাতেমা হাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী রেজওয়ানা মিতু জানায়, তাঁদের মাইটভাঙ্গা গ্রামের বাড়িতে দেড় বছর আগে বিদ্যুত পেয়েছে। ফলে এখন সকল কাজে পর্যাপ্ত আলো বাতাস পাওয়া যায়। লেখাপড়ায় সুবিধা হয়েছে। বাড়ির গৃহিনীর আর হ্যারিকেন কিংবা কুপী বাতি জ্বালাতে হয়না। বহু স্বচ্ছল পরিবারের ঘরে ঘরে ফ্রিজের ব্যবহার চলছে। যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিন বদলের সুফল ভোগ করছেন মানুষ। গ্রামের বাড়িতে বসে পাচ্ছেন শহরের সুবিধা। পেয়েছেন আলোকিত জীবনের সন্ধান।
চাকামইয়া ইউনিয়নের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খামারি রিয়াজ তালুকদার জানান, বিদ্যুতের কোন বিকল্প নাই। বিদ্যুত সুবিধা পেয়ে তিনি ব্যাপকভাবে মুরগির খামার, গবাদিপশু পালন করছেন এবং মাছের চাষও করছেন বৃহত্তর পরিসরে। বললেন, পাম্প চালাতে এখন আর সমস্যা হয় না। বিদ্যুত সুবিধা যেন জীবিকার চাকায় গতি এনেছে। এসেছে সাফল্য। কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুত সমিতির ডিজিএম প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম জানালেন কলাপাড়ায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত আবাসিক গ্রাহক ছিল নয় হাজার। যা বর্তমানে ৫৭ হাজারে পৌছেছে। বেড়েছে ৪৮ হাজার। এভাবে বাণিজ্যিক গ্রাহক বেড়েছে ছয় হাজার দুই শ’, ছিল ১৯ শ’। আর ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ১১০টি, যা ছিল মাত্র ৪০টি।