ইউপি চেয়ারম্যানের ভায়রা শালা-শালি কিংবা দুলাভাইকে ত্রাণের চাল ও সরকারি সহায়তা দেওয়ায় কার্পণ্য করেনি। এভাবে আত্মীয় অথবা ভোটার সমর্থক ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে কাউকে রাখাটা যেন ইউপি চেয়ারম্যানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। এমন স্বেচ্ছাচারীতা-আত্মীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির অনিয়মে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী উপকারভোগীদের মাঝে আর নেই। অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, কাজের বিনিময় খাদ্য, টেস্ট রিলিফ, ভিজিএফ, ভিজিডি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্তা ভাতা, করোনাকালীন প্রণোদনা ইত্যাদিতে ইউপি চেয়ারম্যানের মনগড়া তালিকা অনুসরণ করার ফলে সরকারি সহয়তা সম্পূর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া ট্যাগ অফিসারও চেয়ারম্যানের ছেলের শ^শুর বাড়ির দিকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সব মিলিয়ে বহুবিধ অনিয়মই এখন নিয়মে পরিনত হয়েছে পটুয়াখালী জেলা কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদে। আশ্চর্যজনক হলেও এমনসব অনিয়মের বিষয় রহস্যজনক কারণে উপজেলা প্রশাসনের নজরে না থাকার গুঞ্জন রয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল বিকেলে ইউপি চেয়ারম্যানের ভায়রা ইদ্রিস মেকারের আলীপুরস্থ বাসা থেকে মহিপুর থানা পুলিশ সাড়ে ৪’শ কেজি সরকারি চাল জব্দ করে। এরপর থেকে এলাকার লোকজন এবিষয়ে কমবেশি মুখ খুলতে শুরু করেছে। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী লতাচাপলী ইউনিয়নে বসবাসরত সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবার, ভূমিহীন, কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, উপার্জনে অক্ষম, জেলে পেশার লোকজনকে এই সুবিধার আওতায় নেওয়ার কথা। সেই সাথে একই পরিবারের একাধিক কার্ড কিংবা ভিজিডির সুবিধাপ্রাপ্তরা এই সুবিধা পাবেন না বলেও শর্ত রয়েছে। কিন্তু সরকারের এসব নীতিমালা উপেক্ষা করে ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আনছার উদ্দিন মোল্লা তার পছন্দসই সমর্থক ভোটারসহ আত্মীয়-স্বজনকে এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন। লতাচাপলী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, তার ওয়ার্ডে চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লার শ^শুর বাড়ি। ওই ওয়ার্ডে শ্যালিকা সালমাকে অন্যের নামের চাল ছাড়িয়ে নিয়মিত দিয়ে আসছেন, পেয়েছেন মুজিব শতবর্ষের ঘর। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন শ্যালক মাসুদ বেপারীকে সুপেয় পানির সংরক্ষণাগার। একই ওয়ার্ডের মৃত নুরআলম সুকানীর বিধাব স্ত্রী আকলিমা সরকারি সহায়তার আওতায় নেই। অভিযোগ রয়েছে, তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও ওই ওয়ার্ডের ইয়াকুব দফাদারের ছেলে বজলুকে কখনো সরকারি সহয়তায় সুযোগ দেওয়া হয়নি। আছে ড্রেজারের ও অন্যান্য ব্যবসা জমিজমা ইত্যাদি, তবুও সরকারি সহয়তা পাচ্ছেন থঞ্জুপাড়ার সৈয়দ, রুস্তুম ও গনিদের মতো স্বাবলম্বীরা। শুধু রেশন কার্ডের তালিকায় নাম থাকলেও নিয়মিত চাল পাওয়ার তালিকা থেকে বাদ পড়েনি ইউপি চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লার ভগ্নিপতি পুনামাপাড়া গ্রামের আবুবক্কর মল্লিকও। গত বুধবার চেয়ারম্যানের ভায়রা ইদ্রিসের বাসা থেকে সরকারি চাল পুলিশের হাতে জব্দকালে ভগ্নিপতি আবুবক্কর মল্লিককে ভ্যানগাড়ি বোঝাই করে সরকারি চাল সরিয়ে নিতে দেখে সাংবাদিকদের একাধিক ফোনেও অবহিত করে স্থানীয়রা। অবশ্য আবুবক্কর মল্লিক এমন অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছেন। ২নং ওয়ার্ডের ফাঁসিপাড়া গ্রামের মোঃ ইউনুচ ও তার তিন পুত্র যথাক্রমে সোহেল, রুবেল ও দুলাল একই সঙ্গে জেলে কার্ডে চাল প্রাপ্তির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির অন্যান্য সুবিধাও গ্রহণ করছেন। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবুল হোসেন কাজীর অভিযোগ, ইউপি চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লার অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বলায় তার মতামতের পাত্তা দেওয়া হচ্ছেনা। এমনসব চিত্র ইউনিয়নের প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের। এছাড়া উপকারভোগীদের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদের দৃশ্যমান জায়গায় পৃথক পৃথকভাবে টাঙ্গিয়ে দেবার কথা থাকলেও তা নেই। দুর্নীতির চিত্র জনসম্মুখে উম্মোচনের ভয়ে দীর্ঘদিনেও এই তালিকা দৃশ্যমান স্থানে রাখা হয়নি বলেও অভিযোগ ইউপি সদস্যের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজেরা দান-অনুদান দিতে পারেন এমনসব পরিবারের নামও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে এই তালিকায়। ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড সদস্য মোঃ আলম ফকির বলেন, চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন ব্যক্তিরা চাল ছাড়িয়ে বিক্রি করছে, অথচ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় বহু অতি দরিদ্রদের জায়গা দেওয়া যায়নি। ইউনিয়নের পুনামাপাড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ভ্যানচালক শহিদ, মাইটভাঙ্গা গ্রামের মৃত আর্শেদ মোল্লার পুত্র জেলে দেলো মোল্লা, দিয়ার আমখোলাপাড়া গ্রামের চান্দুর বিধবা স্ত্রী বেগম ও একই গ্রামের মনসুরের বিধবা স্ত্রী রাবেয়ার মতো অগণিত পরিবারের সরকারি সহায়তায় ভাগ বসিয়েছে ইউপি চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ মধ্যবিত্তরা। এসব অভিযোগের বিষয় ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আনছার উদ্দিন মোল্লাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আত্মীয় অনাত্মীয়ের বিষয় নয়, সরকারি সহায়তা পাবার মাপকাঠিতে পড়লে যে কারও নাম তালিকায় থাকতে পারে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসনাত মোঃ শহীদুল হক বলেন, অনিয়মের অভিযোগ থাকলে আমাদের লিখিতভাবে জানালে যাচাই বাছাই শেষে বাদ দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবো।