বার্তা ডেস্ক ॥ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরিশালের ছয়টি আসনে ইতোমধ্যে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শীতের আগমনী বার্তার সাথে সাথে গ্রামের প্রতিটি পাড়া ও মহল্লার চায়ের দোকানগুলোতে শুরু হয়েছে নির্বাচনী আলোচনা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা পেতে নতুন নতুন প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ থেকে শুরু করে চলমান দুর্গাপূজায় বিভিন্ন মন্ডব পরিদর্শন করে হিন্দু নেতাদের সাথে মতবিনিময় শুরু করেছেন। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে বেশির ভাগ আসনে রয়েছে যোগ্য প্রার্থী সংকটে। মাঠের বিরোধী দল বিএনপির দীর্ঘ প্রার্থী তালিকা থাকলেও গতানুগতিক নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ নেই তাদের। যেকারণে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে মাঠে নেই বিএনপি। তৃণমূল বিএনপি থেকেও তেমন কোন সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বরিশালে। তবে ছয়টি আসনেই প্রার্থী রয়েছে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের। ওয়ার্কার্স পার্টি এবং বিভক্ত জাসদের দুই গ্রুপ থেকে দুটি আসনে প্রার্থী রয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ ও এনপিপি একটি করে আসনে প্রার্থী দিতে পারে। সবমিলিয়ে ছয়টি আসনে প্রায় শতাধিক নেতা বিভিন্ন দলের মনোনায়ন পেতে নীরব প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। এরমধ্যে সিংগভাগ প্রার্থী রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে।
বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) ॥ বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি এ আসনে দলের একমাত্র প্রার্থী। এখানে বিএনপির প্রার্থী তালিকায় থাকা সাবেক এমপি ও দলের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুুসুর রহমান দীর্ঘবছর থেকে নিজ নির্বাচনী এলাকার বাহিরে রয়েছেন। তাদের দাবি ক্ষমতাসীন দলের লোকজন তাদের এলাকায় আসতে দিচ্ছেন না। তবে তাদের দাবি পুরোটাই মিথ্যে প্রমানিত করে দিয়েছেন অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান। তিনি প্রায় প্রতিটি দলীয় কর্মসূচি নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকায় পালন করে দলকে সু-সংগঠিত করে রেখেছেন। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন, কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য অ্যাডভোকেট সেকান্দার আলী সেরনিয়াবাত এবং এসএম রহমান পারভেজ। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মোঃ মেহেদী হাসান রাসেল। ইতঃপূর্বে সংসদীয় এ আসনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হলেও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাহিরে থাকায় ভোটারদের সাথে দল দুটির প্রার্থীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) ॥ এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা দীর্ঘ। বর্তমান এমপি মোঃ শাহে আলম, সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস, সাবেক এমপি মনিরুল ইসলাম মনি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও ডেসকোর পরিচালক আনিসুর রহমান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান খান, শের-ই বাংলা একে ফজলুল হকের দৌহিত্র ফাইয়াজুল হক রাজু, জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ ও বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এম মোয়াজ্জেম হোসেন, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবিদ আল হাসান ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ সুখেন্দু শেখর বৈদ্য। আসনটিতে ক্লিন রাজনীতির কারণে মনোনয়ন দৌঁড়ে এগিয়ে রয়েছেন সাবেক এমপি তালুকদার মোঃ ইউনুস। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন দলের এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, সাবেক এমপি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও রওনাকুল ইসলাম টিপু। কিন্তু মাঠে তাদের কাউকেই দেখা যায়নি। এখানে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ইসলামি যুব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা নেছার উদ্দিন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বরিশাল-৩ আসনের বর্তমান এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু। ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী অধ্যাপক মন্টু লাল কুন্ডু ও জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য জহিরুল ইসলাম টুটুল। জাসদ আম্বিয়া গ্রুপের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন, আবুল কালাম আজাদ বাদল ও মোঃ আনিচুজ্জামান। জাসদণ্ডইনু থেকে প্রার্থী হবেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সহকারী একান্ত সচিব মোঃ সাজ্জাদ। ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টির সাহেব আলী রনি নিজেই এখানে প্রার্থীতা ঘোষণা করেছেন।
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) ॥ বিগতদিনে জোটভুক্ত নির্বাচনে শরিকদের এই আসন ছেড়ে দেয়ার কারণে টানা মেয়াদে এখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোণঠাসা রয়েছেন। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের সবধরনের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত এ আসনে এবার আওয়ামী লীগ থেকে একক প্রার্থী দেওয়ার জন্য কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকখ্যাত এ আসনে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আতিকুর রহমান। পাশাপাশি দলের কাছে মনোনয়ন চাইতে পারেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান, সহসম্পাদক জহির উদ্দীন খসরু, মুলাদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তারিকুল হাসান খান মিঠু, বাবুগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সরদার খালেদ হোসেন স্বপন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোঃ সাফায়াত হোসেন সজিব। ইতোমধ্যে একাধিক সভায় দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ভোটারদের সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে শীর্ষে থাকা বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য আতিকুর রহমান বলেন, জোট-মহাজোটের কারণে স্থানীয়ভাবে দলের ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া যুগ যুগ ধরে উন্নয়ন বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। দলীয় নেতাকর্মীরা অনেকটা অভিভাবকশূন্য। ১৯৭৩ সালের পর এ দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৩ আসনে সংসদ সদস্য পায়নি আওয়ামী লীগ। প্রতিবারই আসনটি মহাজোটের শরিক দলগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ শরিক দলের এখানে পাঁচ হাজার ভোটও নেই। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন নিজেদের পক্ষে চান আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বর্তমান এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শেখ মোঃ টিপু সুলতান। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলের জেলা কমিটির সেক্রেটারি উপাধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম।
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) ॥ এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনায়ন প্রত্যাশী বর্তমান এমপি পঙ্কজ দেবনাথ, দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, ঢাকা মহানগর (উত্তর) আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান। অবশ্য এ আসনে বর্তমান এমপি পঙ্কজ দেবনাথ তৃণমূল নেতাকর্মীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন। তাদের মতে, পঙ্কজ দেবনাথকে দল থেকে মনোনয়ন না দিলে এ আসনটি হারাতে পারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন-সাবেক এমপি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হতে পারেন চরমোনাই পীরের ছোট ভাই মাওলানা সৈয়দ নুরুল করীম।
বরিশাল-৫ (সদর) ॥ এ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বর্তমান এমপি ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম এবারো মনোনয়ন চাইবেন। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ সদর আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এলক্ষ্যে তিনিও মাঠ গোছানো শুরু করেছেন। তবে নির্বাচনী মাঠে না থাকলেও আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার। এছাড়াও মনোনয়ন চাইতে পারেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন-দলের যুগ্ম মহাসচিব ও পাঁচবারের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংরক্ষিত এমপি অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিন, জেলা দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়দুল হক চাঁন এবং কেন্দ্রীয় সদস্য আবু নাসের মোঃ রহমতউল্লাহ। জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও মহানগর জাপার সদস্য সচিব প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস এবং জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কেএম মতুর্জা আবেদীন। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলের সিনিয়র নায়েবে আমির ও চরমোনাই পীরের মেঝ ভাই মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম।
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) ॥ বিগত দিনে এই আসনে মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। তবে উন্নয়ন বঞ্চিত বাকেরগঞ্জের ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এবার আর আসনটিতে ছাড় দিতে নারাজ। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) হাফিজ মল্লিক, বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল হক মঞ্জু ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বাস মুতিউর রহমান বাদশা। বিএনপির মনোনয়ন তালিকায় রয়েছেন-জেলা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান রাজন। এখানে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান এমপি নাসরিন জাহান রত্না আমিন। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা নুরুল ইসলাম আল-আমিন এবং জাসদের (ইনু) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোহসীন। সার্বিক বিষয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, স্বাধীনতার পর বর্তমান সরকারের আমলে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। তাই এখানকার ভোটাররা নৌকাতেই ভোট দেবেন। প্রার্থী বাছাই প্রশ্নে তিনি বলেন, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী মাঠজড়িপের মাধ্যমে যাকে মনোনয়ন দেবেন আমরা তার বিজয় নিশ্চিত করতেই কাজ করবো।