আজকের বার্তা
আজকের বার্তা

বরিশালে বেল ইসলামিয়ার শতকোটি টাকার সম্পদ বেহাত হওয়ার শঙ্কা


আজকের বার্তা | প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২ ২:৪৪ অপরাহ্ণ বরিশালে বেল ইসলামিয়ার শতকোটি টাকার সম্পদ বেহাত হওয়ার শঙ্কা
Spread the love

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বরিশাল নগরের বাণিজ্যিক এলাকা হেমায়েত উদ্দিন সড়কে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ একটি ভবন। কশাই মসজিদের পশ্চিম পাশের ভবনটির নাম ‘বেল ইসলামিয়া (বিআই) হোস্টেল’। ১২৭ বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এখন ভবনটি নগরের অন্যতম পুরার্কীতি।

তবে এটি পরিচালনায় ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যর্থতায় শতকোটি টাকার এই সম্পদ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রতিষ্ঠানটি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটাতে ৩০ বছর আগে নিজেদের জমিতে নির্মাণ করা হয় বাণিজ্যিক ভবন। এতে আয় বাড়লেও প্রাচীন বিআই হোস্টেল রক্ষায় কোনো উদ্যোগই নেয়নি ট্রাস্টি বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটির কেন এমন বেহাল অবস্থা, এটির বার্ষিক আয় কত, আয়ের টাকা কোথায় যায়- এসবের উত্তর মিলছে না কোথাও। ট্রাস্টি বোর্ডের স্বচ্ছতাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৫ সালের পর এই প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিরীক্ষণও (অডিট) করা হয়নি। বছরে পর বছর হয় না ট্রাস্টি বোর্ডের সভা। পদাধিকারবলে সভাপতি জেলা প্রশাসক নিজেও জানেন না তিনি এটির দায়িত্বে আছেন।

জানা গেছে, তৎকালীন সময়ে মুসলিম দরিদ্র ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে ১৮৯৫ সালে তাৎকালীন খান বাহাদুর মৌলভী হেমায়েত উদ্দিন ৯৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ জমিতে বিআই হোস্টেল নির্মাণ করেছিলেন। তখনকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিকোলাস বিটসেন বেলের নামে ‘বেল ইসলামিয়া হোস্টেল’ নামকরণ করা হয়। ১৯৯১ সালে মূল ভবনের পশ্চিম পাশে ইসলামিয়া মার্কেট নামে তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনটি হোস্টেল কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করে। এর নিচতলায় ২৭টি স্টল ভাড়া নিয়েছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা। দোতলা ও তিনতলায় মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান। ভবনটি বিআই হোস্টেলের একমাত্র আয়ের উৎস। সেখান থেকে প্রতি মাসে কত টাকা আয় হচ্ছে, আয়ের টাকায় হোস্টেলের সংস্কার হচ্ছে না কেন- তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভবন নির্মাণের পর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিচতলার ২৭টি স্টল। তখন সামনের দিকের স্টল ২ হাজার টাকা করে এবং মাঝে ও পেছনের দিকের স্টল ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকা ভাড়া দেন ব্যবসায়ীরা। ২৪ বছর পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে ব্যবসায়ীরা মামলার ফাঁদে ফেলেন।

পরে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ঠিকই, তবে ওই এলাকার অন্য মার্কেটের চেয়ে তা অনেক কম। একই অবস্থা মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভাড়ার ক্ষেত্রেও। নিচতলার মার্কেট এবং ওপরের মেডিনোভা সেন্টার থেকে কত টাকা ভাড়া আসছে তা রহস্যবৃত। সূত্র জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী মেডিনোভার মোট ভাড়ার মধ্যে এক-চতুথাংশ নগদ, বাকি টাকা বিআই হোস্টেলের হিসাব নম্বরে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। নগদ টাকা বহু বছর ধরে অফিসে জমা হচ্ছে না। ওই টাকা কোথায় যাচ্ছে তাও কেউ জানে না। হোস্টেলের আয়-ব্যয়-সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে সুপারিনটেনডেন্ট মো. মঞ্জুরুল ইসলাম তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে জানানো হয়, মাসিক সভার সিদ্ধান্ত ছাড়া তথ্য দেওয়া যাবে না। কবে সভা হবে তাও সঠিকভাবে জানাতে পারেননি সুপারিনটেনডেন্ট। সূত্র জানায়, নিচতলার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হোস্টেল কর্তৃপক্ষকে জিম্মি করে রেখেছেন। মার্কেট নির্মাণের পরই ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন সিকদার ও তাঁর পরিবারের নামে পাঁচটি স্টল বরাদ্দ নেওয়া হয়। আনোয়ার হোসেন সিকদার এখন সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর শ্বশুর। মালিক পক্ষকে (বিআই হোস্টেল) চাপে রাখতে ব্যবসায়ীরা মেয়রের শ্বশুরকে ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পদে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, ১৯০৫ সাল থেকে ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারবলে সভাপতি জেলা প্রশাসক এবং সদস্য সচিব হলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।

একমাত্র সদস্য অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যল। দীর্ঘদিন শূন্য দুটি সদস্যপদ। সদস্য সচিব স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকায় গত কয়েক বছরে ট্রাস্টি বোর্ডের সভাও হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে গঠিত ট্রাস্টি দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্পত্তি ও অর্থ নিয়ে ঘাপলা দেখা দেয়। এর আগে ভালোভাবেই চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। আমার জানামতে বর্তমানে ট্রাস্টির হাতে (ব্যাংক হিসাবে) কোটি টাকার ওপরে জমা আছে। যা দিয়ে পুরার্কীতি ভবনটি সংস্কার করা সম্ভব। ট্রাস্টির ব্যর্থতায় বাণিজ্যিক ভবনটিও ব্যবসায়ীদের কাছে হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদস্য সচিব ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, আমি স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকায় অপর সদস্য মানবেন্দ্র বটব্যল বিষয়টির দেখভাল করেন। প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক ভবন থেকে সব আয় ব্যাংকের হিসাব নম্বরে জমা হচ্ছে। করোনার কারণে গত কয়েক বছরে ট্রাস্টি বোর্ডের সভা হয়নি। বাকি বিষয়গুলো মানবেন্দ্র বটব্যলের সঙ্গে আলোচনা করার পরমর্শ দেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। মানবেন্দ্র বটব্যল বলেন, ব্যবসায়ীদের দেওয়া অগ্রিম টাকায় বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়। যে কারণে ব্যবসায়ীরা ভাড়া কিছুটা কম দিচ্ছেন। আয়ের পুরো টাকাই একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব নম্বরে জমা হচ্ছে। এক টাকাও তছরুপ হয়নি। ২০১৫ সালের পর আয়-ব্যয় অডিট নিরীক্ষণ এবং ট্রাস্টির সভা না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার কারণে হয়নি। শতবর্ষী ভবনটি রক্ষা করতে না পারা প্রসঙ্গে মানবেন্দ্র বটব্যল বলেন, কয়েকটি সরকারি দপ্তরের প্রকৌশলী বিভাগ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ভবনটি সংস্কার করা সম্ভব নয়। এখন বেসরকারি প্রকৌশল ফার্ম দিয়ে চেষ্টা করা হবে। জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন হায়দারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর তিনি বরিশালে কর্মরত। বরিশালে ১২৭ বছরের পুরোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আছে এবং তিনি সভাপতি, বিষয়টি এ পর্যন্ত কেউ তাঁকে জানাননি। এখন তিনি এটির খোঁজখবর নেবেন।